জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রথম বাজেট পেশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তবে এ বাজেট পেশ করেছেন তিনি টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি দেশবাসীর কাছে। এই বাজেটে বিগত সরকারের মতো অর্থনীতিকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানোর প্রবণতা নেই। রাজস্ব আদায় না হলেও প্রতিবছর বাজেট বড় করার প্রতিযোগিতায়ও নামেননি বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর।
গতকাল সোমবার বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাবনা তুলে ধরেন তিনি। অন্যান্য বছর অর্থমন্ত্রীরা ব্রিফকেস হাতে নিয়ে জাতীয় সংসদে হাজির হলেও সালেহউদ্দিন আহমেদকে দেখা যায় একটি সাদা ফাইল হাতে।
সংসদ না থাকায় আসন্ন অর্থবছরের বাজেট অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এই বাজেটে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া এবং অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে নজর দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম বাজেট প্রস্তাব করেছেন তিনি। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম আগের বছরের তুলনায় বাজেটের আকার কমল।
বাজেট বাস্তবায়নে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ কোটি টাকা। অনুদান ছাড়া ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। বিদেশি অনুদান পেলে ঘাটতি হবে ২ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা; যা মোট দেশজ উৎপাদনের ৩.৬ শতাংশ।
বিলাসী বিদেশি পণ্য আমদানির শুল্ক-কর বাড়িয়ে এ খাতের বেশ কিছু পণ্যের চাহিদা কমানোর কথা বলেছেন অর্থ উপদেষ্টা। একই সঙ্গে তরুণ উদ্যোক্তা, নারী উদ্যোক্তা ও দেশীয় শিল্প সুরক্ষার দিকেও নজর দিয়েছেন তিনি।
বক্তৃতার শেষ পর্যায়ে সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আপাতত প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধির পরিবর্তে অর্থনীতির ভিত মজবুত করার দিকে আমরা অধিকতর মনোযোগ দিচ্ছি। এ শক্তিশালী ভিতই হবে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের সোপান। আগামীর সেই বাংলাদেশে সবার জন্য মানসম্মত জীবন এবং সকল স্তরে বৈষম্যহীন ব্যবস্থার নিশ্চয়তা প্রদান হবে আমাদের মূল লক্ষ্য।’
বাজেটে জুলাই অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের জন্য ৪০৫ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্থাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। এ ছাড়া জুলাই যোদ্ধাদের পরিবারের আয়কর সীমাও বাড়িয়ে ৫ লাখ ২৫ হাজার টাকা করা হয়েছে।
এবারের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। অন্যদিকে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
ঘাটতি অর্থায়নের ক্ষেত্রে নিট বৈদেশিক ঋণ দাঁড়াবে ৯৬ হাজার কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ নেয়া হবে এক লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংক থেকে নেয়া হবে এক লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেয়া হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় ধরা হয়েছে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ এক লাখ কোটি টাকা। এ ছাড়া বৈদেশিক ঋণের সুদ ২২ হাজার কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এনবিআরবহির্ভূত কর ধরা হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কর ছাড়া অন্য খাত থেকে পাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৬ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ৩১৭ কোটি টাকা। পরিচালন ব্যয়ের মধ্যে আবর্তক ব্যয় ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে এক লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। পাশাপাশি ৩৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা ধরা হয়েছে মূলধন ব্যয় বাবদ।
আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্কিমে ব্যয় হবে ৫ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা। এডিপি বহির্ভূত বিশেষ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৭৫১ কোটি টাকা। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচি (এডিপি বহির্ভূত) ও স্থানান্তরে ২ হাজার ৫৫৫ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি, বিদেশি ঋণের কঠোর শর্ত আর রাজস্ব ঘাটতির বাস্তবতায় বাজেট প্রস্তাবে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ধরেছেন তিনি; যা বহু বছরের মধ্যে কম। অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে এ লড়াইয়ের ফলে আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার অন্যান্য বছরের তুলনায় কিছুটা কম হতে পারে।
এ বছর বেশ কিছু মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দ কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে ডাক ও টেলিযোগাযোগ, রেল মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ বেশ কিছু ভাতার হার বৃদ্ধি করার প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
এদিকে জ্বালানির ব্যয় কমাতে এলপিজির শুল্ক কমানো, তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকার স্টার্টআপ তহবিল, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ১২৫ কোটি টাকার তহবিল বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।
এবার জমির নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে উৎসে কর কমানো হয়েছে। জমি বা সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় রেজিস্ট্রেশনের আগে উৎসে কর দিতে হয়, যেটিকে অনেক সময় মূলধনি মুনাফার ওপর কর হিসেবেও দেখা হয়। এই উৎসে করহার এলাকাভেদে কমানো হয়েছে।
বর্তমানে জমি বা সম্পত্তি হস্তান্তরের সময় উৎসে কর আদায় হতো ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনে ৮ শতাংশ, অন্যান্য সিটি করপোরেশন এলাকার জন্য ৬ শতাংশ এবং পৌরসভা বা ইউনিয়ন পর্যায়ে ৪ শতাংশ। সেটি কমিয়ে যথাক্রমে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ করা হয়েছে।
সরকার বলছে, মানুষকে আসল বিক্রয়মূল্য অনুযায়ী রেজিস্ট্রেশনে উৎসাহিত করতে, যাতে কম দাম দেখিয়ে ট্যাক্স ফাঁকি না দেয়। জমি বা ফ্ল্যাট কেনাবেচায় বিকল্প পথে লেনদেন কমিয়ে আনতে যেমন দলিল কমমূল্যে রেজিস্ট্রি করা এবং রিয়েল এস্টেট খাতকে গতিশীল করতে এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এদিকে আবার কালো (অপ্রদর্শিত অর্থ) টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি বলছে, সরকার দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে, যা অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি। অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে রাষ্ট্রসংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যকে রীতিমতো উপেক্ষা করেছে তারা। তিনি মনে করেন, সরকার দুর্নীতিকে উৎসাহ দিয়ে রিয়েল এস্টেট লবির ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, বাজেটে বেশ কিছু পণ্যর শুল্ক যৌক্তিকীকরণ করা হয়েছে। এর ফলে শিল্প খাত চাপে পড়বে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, শুল্ক যৌক্তিকীকরণ দরকার ছিল। তবে ব্যবসা করার খরচও কমাতে হবে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাজেটের দর্শন বৈষম্যবিহীন সমাজ। কিন্তু বাস্তবতার সঙ্গে তা পুরোপুরি সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। তিনি মনে করেন, শিক্ষা খাতে এডিপি বরাদ্দ তুলনামূলক কম রাখা উদ্বেগজনক। করমুক্ত আয় ৩ লাখ ৭৫ করাকে ভালো পদক্ষেপ বলেও জানিয়েছে সিপিডি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, এবারের বাজেটে আমরা তলানি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর একটি চেষ্টা দেখতে পেয়েছি। অর্থনীতি যেভাবে একটা লুটেরাদের হাতে চলে গিয়েছিল, শিল্প খাত একটি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে গিয়েছিল তা পুনরুদ্ধারের একটি আভাস রয়েছে এই বাজেট প্রস্তাবনায়।