ছেলের ব্যবহৃত হাতঘরি, দুটি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, নামাজের টুপি, তসবি, ব্রাশ, না খাওয়া চকলেট, জুতা, জামাকাপড়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ড, নিত্য ব্যবহার্য জিনিষগুলি স্ব-যতেœ রেখেছেন মা রোকেয়া খাতুন। এছাড়াও আলমারিতে সুরক্ষিত আছে ছেলের অর্জিত বিভিন্ন পুরষ্কার। সর্বশেষ কিনে দেয়া অক্ষত মোড়কের নতুন জামাটিও রয়েছে মায়ের সংগ্রহশালায়। হলে থাকা কাপড় চোপড় পরম যতেœ রেখেছেন বাড়িতে যে কক্ষটি ছিলো আরবারের থাকার জন্য। থরে থরে সাজিয়ে রেখেছেন ছেলের পড়া বই। আবরার ফাহাদ মারা গেলেও তার মা তার স্মৃতি গুলোকে সংরক্ষণ করে আগলে রেখেছেন।
রবিবার সন্ধায় কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই রোডের শাখা বীর মুক্তিযোদ্ধা আসাদ সড়কের ০৫ নং ওয়ার্ডের ০০০৩ নং বাড়ীতে বড় ছেলে কিছু বিপথগামী সহপাঠীদের নৃসংশ হত্যাকান্ডে প্রয়াত বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের রেখে যাওয়া স্মৃতির সাথে বিড়বিড় করে নিজের মনেই কথা বলে একাকী দিন কাটান মা রোকেয়া খাতুন। পুলিশের কাছ থেকে ফেরত পাওয়া এন্ড্রয়েট মোবাইলটি এবং আসুস ল্যাপটপটি নাড়াচাড়া করতে করতে প্রলাপ কলে বলেন, ‘এই মোবাইলটাই ওর জীবনের কাল হয়ে দাঁড়ালো, আমি কি জানতাম যে মোবাইলে ফেসবুকে পোষ্ট করে ওর জীবন যাবে তাহলে তো মোবাইল কিনে দিতাম না’।
আবরারের বাবা বরকতউল্লাহ ব্র্যাকে কর্মরত নিরীক্ষক হিসাবে ঢাকায় থাকেন। মূলত: ছোট ছেলে ফায়াজের পড়ালেখার জন্যই তিনি পোষ্টিং নিয়ে থাকেন ঢাকায়। কুষ্টিয়ার বাসায় শুধু থাকেন আবরার ফাহাদের মা।
রোকেয়া খাতুন আবরারের বিভিন্ন স্মৃতি চারণ করে বলেন, “যেদিন আমার ছেলে বাড়ি থেকে গিয়েছিলো সেদিন ছিলো ০৬ তারিখ রবিবার। ৫ বছর পরে আজকে ঠিক সেই রবিবার এবং ৬ তারিখ। আজকের এই দিনেই সকালে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসেছিলাম। বার বার ফোন দিয়ে বলছিলো কোথায়। জ্যাম ছিলো না তাও বার বার বলছিলো যে দেরি হচ্ছে। হয়তো এটাই ছিলো ওর জীবনে শেষ যাত্রা।”
তিনি বলেন, “সেদিন কেউ এগিয়ে আসে নাই। কত ছাত্র ছিলো দারোয়ান ছিলো কেউ এগিয়ে আসেনি। আমার ছেলেকে ওরা শিবির বলে মেরে ফেলেছে। আমার ছেলেকে অনেক কষ্ট দিয়ে মেরেছে। আমার ছেলের কথা গুলো আমার কানে বাজে। আজ ৫ বছর চলে গেছে আমি কিছুই ভুলতে পারিনি।”
তিনি বলেন, নি¤œ আদালতে মামলার রায় হয়েছিলো। ২০জনের মৃত্যুদন্ড ও ৫জনের যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আদালত। আসামীদের মধ্যে এখনও যে ৩জন পলাতক রয়েছে তাদের যেন দ্রুত গ্রেফতার করা হয় এবং দ্রুত রায়টা কার্যকর করা হয়। তবে জেল থেকে আবরারের খুনিরা পালিয়ে গেলো কিনা সেটাও আমি আশঙ্কা করছি।
আবরারের মা জানান, “আমার ছেলে দেশের মানুষের জন্য ফেসবুকে ইলিশ মাছ নিয়ে লিখেছিলো। পানি চুক্তির অসমতা নিয়ে লিখেছিলো ও দেশকে অনেক ভালোবাসতো। ও কোন দল বা রাজনীতির কারণে ফেসবুকে লিখেছিলো না। আমরা সবাই চাই দেশের সাধারন মানুষগুলো ভালো থাক।”
তিনি কোটা আন্দোলনে নিহত সকলের প্রতি দোয়া এবং আবরারের জন্য সকলের কাছে দোয়া প্রার্থনা করেন। কারন ২০১৮ সালে প্রথম কোটা বিরোধী আন্দোলনে আবরারও সেদিন ছিলো রাজপথে।
উল্লেখ্য ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর রাতে বুয়েটের শেরেবাংলা হলে ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগ নামধারী তারই কিছু বিপথগামী সহপাঠীরা। এ ঘটনায় সারা দেশে জনবিক্ষুব্ধতায় তোলপাড় হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট চকবাজার থানায় হত্যা মামলা করেন নিহত আবরার ফাহাদের বাবা। ওই বছরের ১৩ নভেম্বর ২৫ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) পরিদর্শক ওয়াহেদুজ্জামান। মামলার রায়ে ২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর বুয়েটের ২০ শিক্ষার্থীকে মৃত্যুদ- এবং ৫ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় ট্রাইব্যুনাল। মামলাটি এখন উচ্চ আদালতে আপিল নিষ্পত্তি ও আসামিদের ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় আছে।
মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা হলেন- অনিক সরকার, ইফতি মোশাররফ সকাল, মো. মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, মেহেদী হাসান রবিন, মো. মনিরুজ্জামান মনির, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম তানভীর, শিক্ষার্থী মো. মুজাহিদুর রহমান ও এএসএম নাজমুস সাদাত, মেহেদী হাসান রাসেল, মুনতাসির আল জেমি, আবরারের রুমমেট মিজানুর রহমান, শাসছুল আরেফিন রাফাত, মো. মাজেদুর রহমান মাজেদ, শামীম বিল্লাহ, হোসেন মোহাম্মাদ তোহা, মোর্শেদ অমত্য ইসলাম ও এস এম মাহমুদ সেতু, মোর্শেদ-উজ-জামান মন্ডল ওরফে জিসান, এহতেশামুল রাব্বি ওরফে তানিম ও মুজতবা রাফিদ।
যাবজ্জীবন কারাদ- প্রাপ্তরা হলেন-অমিত সাহা, মুহতামিম ফুয়াদ, ইশতিয়াক আহম্মেদ মুন্না, আকাশ হোসেন ও মুয়াজ ওরফে আবু হুরায়রা।