X

ইসলামের সোনালি যুগে চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়ন

মুসলিম সভ্যতায় চিকিৎসাশাস্ত্রের যাত্রা শুরু হয়েছিল মুহাম্মদ (সা.)-এর যুগেই। চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নয়নে তিনি যেমন উৎসাহ দিয়েছেন, তেমনি নিজেও এই শাস্ত্রের চর্চা করেছেন। তবে তিনি কোনো চিকিৎসক ছিলেন না। তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের ঠিক ততটুকু চর্চা করেছেন, যতটুকু ওহির মাধ্যমে লাভ করেছেন।

বস্তুত মহান আল্লাহ তাঁকে ওহির মাধ্যমে চিকিৎসাশাস্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়েছিলেন। ফলে মহানবী (সা.) নিজে রোগীদের সেবা করতেন এবং তাদের পরামর্শ দিতেন। তিনি তাঁর স্ত্রীদের চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞান লাভে উৎসাহিত করেন। মহানবী (সা.) প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতেন।

সাহাবিদের তিনি চিকিৎসাশাস্ত্রের অনেক মূলনীতি শিক্ষা দিয়েছেন। যেমন তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহ আরোগ্যহীন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘(নিয়ন্ত্রিত) খাদ্য গ্রহণ সুস্থ থাকার মূলমন্ত্র এবং অসংযম সব অসুস্থতার উৎস।’ তিনি বলেছেন, ‘জ্বরকে পানি দিয়ে ঠাণ্ডা করো।’

হাদিসের সুবিশাল ভাণ্ডারে চিকিৎসাবিষয়ক অসংখ্য হাদিস রয়েছে। হাদিসগ্রন্থগুলো রোগ, রোগী ও চিকিৎসা বিষয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে। যেমন- ইমাম বুখারি (রহ.) সহিহ বুখারিতে ‘কিতাবুল মারদা’ ও ‘কিতাবুত তিব’ নামের দুটি অধ্যায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম জাওজি (রহ.) ‘আত তিব্বুন নববী’ গ্রন্থ রচনা করেছেন, যাতে তিনি মহানবী (সা.) চিকিৎসাশাস্ত্র সংশ্লিষ্ট নির্দেশাগুলো একত্র করেছেন। এই বইয়ে ১০০-এরও অধিক রোগ ও তার নিরাময় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।

মহানবী (সা.)-এর পরিবারের সদস্যরাও চিকিৎসাশাস্ত্রে পারদর্শী ছিলেন। সাইয়েদা আয়েশা (রা.) চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষ ভাগে পারদর্শী ছিলেন। আল্লামা আবু ওমর ইবনে আবদুল বার (রহ.) বলেন, ‘আয়েশা (রা.) তাঁর যুগে তিনটি শাস্ত্রে অদ্বিতীয় ছিলেন। তা হলো ফিকহ (ইসলামী আইন), চিকিৎসাশাস্ত্র ও কাব্যশাস্ত্র।’ (মুসনাদে ইসহাক : ২/৩০)।

আরবের বিখ্যাত নারী চিকিৎসক ছিলেন শিফা বিনতে আবদুল্লাহ (রা.)। চর্মরোগের চিকিৎসায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা ছিল। তিনি নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশ নেন এবং যুদ্ধাহতদের চিকিৎসাসেবা দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁকে নির্দেশ দেন তিনি যেন হাফসা (রা.)-কে চিকিৎসাবিদ্যা শেখান। (আল-ইসাবা : ৮/১২১)।

কোনো সন্দেহ নেই, চিকিৎসাশাস্ত্রে মহানবী (সা.) ও তাঁর পরিবারের অংশগ্রহণ অন্য সাহাবিদেরও এই শাস্ত্রের প্রতি উৎসাহিত করেছে। এ কারণেই সাহাবিরা ও মহান চার খলিফার সবাই চিকিৎসাশাস্ত্রের পাঠ গ্রহণ, পাঠদান ও চর্চায় পরিপূর্ণ সমর্থন জুগিয়েছেন। ফলে কিছুদিনের ভেতর ইসলামী চিকিৎসাশাস্ত্র সাফল্যের শীর্ষচূড়া স্পর্শ করে। সাহাবিদের ভেতর অনেকেই চিকিৎসক হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন।

এমন কয়েকজন বিখ্যাত চিকিৎসক সাহাবির পরিচয় তুলে ধরা হলো-

১. আবু রমসা (রা.) : তাঁর পুরো নাম আবু রামসা হাবিব ইবনুল হাসসান (রা.)। ক্ষতস্থানের চিকিৎসায় তিনি বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন। ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করায় তাঁকে ‘জাররাহ’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। জাররাহ শব্দটি আরবি জারহুন (ক্ষতস্থান) শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। (জুহুদুস সাহাবাতি তিব্বিয়্যাতে আলা আহদির রাসুল, পৃষ্ঠা-১২)।

২. জিমাদ বিন সালাবা আল আজদি (রা.) : তিনি জাহেলি যুগে মহানবী (সা.)-এর বন্ধু ছিলেন। প্রাথমিক যুগেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। তিনি পেট ফাঁপার চিকিৎসা করতেন। মানুষকে ঝাড়ফুঁকও করতেন। (জুহুদুস সাহাবাতি তিব্বিয়্যাতে আলা আহদির রাসুল, পৃষ্ঠা-১২)।

৩. শমরদল নাজরানি (রা.) : তাঁর পুরো নাম শমরদল বিন কুবাস কাবি নাজরানি (রা.)। মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে তাঁর চিকিৎসা বিষয়ে আলোচনা হয়। তিনি নাজরান থেকে আসা বনি হারিস বিন কাবের প্রতিনিধিদলে ছিলেন। শমরদল (রা.) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সামনে বসেন। তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার জন্য আমার মা-বাবা উৎসর্গ হোক। আমি জাহেলি যুগে গণক ছিলাম। আমি চিকিৎসাও করতাম। আমার জন্য কি তা জায়েজ? আমার কাছে যুবতি নারীরা আসে। তিনি বলেন, তুমি শিরার রক্তপাত করো (শিরার দূষিত রক্ত বের করে দাও), প্রয়োজন অনুপাতে ক্ষতস্থানের চিকিৎসা করো, তোমার ওষুধে শুবরুম ব্যবহার কোরো না, তবে সানা (সোনালি লতা) ব্যবহার করতে পারো। রোগ চিহ্নিত না করে কারো চিকিৎসা কোরো না। শমরদল (রা.) বলেন, সেই সত্তার কসম, যিনি আপনাকে সত্য নবী হিসেবে পাঠিয়েছেন। আপনি চিকিৎসাশাস্ত্রে আমার চেয়ে অগ্রগামী। (আল-ইসাবা : ৩/২৮৮)।

মহানবী (সা.)-এর যুগে শুধু পুরুষরাই চিকিৎসাশাস্ত্রে অংশ গ্রহণ করেননি, বরং এই শাস্ত্রে নারীদেরও বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। যেমন-

৪. রুফাইদা আসলামিয়া (রা.) : রুফাইদা বিনতে সাআদ আল আনসারিয়া (রা.) ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের প্রথম নারী চিকিৎসক। মহানবী (সা.)-এর সময় মদিনায় তাঁর নিজস্ব চিকিৎসাকেন্দ্র ছিল এবং তিনি যুদ্ধাভিযানে মুসলিম চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দিতেন। নবীজি (সা.) তাঁকে মসজিদে নববীতে একটি তাঁবু স্থাপনের অনুমতি দেন, যা ‘খিমাতু রুফাইদা’ নামে পরিচিত ছিল। এটাকেই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম চিকিৎসাকেন্দ্র বলা হয়। তিনি সেখানে মানুষকে চিকিৎসাসেবা দিতেন। রুফাইদা (রা.) শুধু নিজে চিকিৎসা দিতেন না, বরং তিনি মুসলিম নারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও রোগীদের যত্ন নেওয়ার পদ্ধতি শেখাতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মদিনায় নারীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসক দল তৈরি হয়েছিল। (উসদুল গাবাহ : ৭/১১১; আল ইসাবা : ৮/১৩৫)।

৫. উম্মে আতিয়্যা (রা.) : উম্মে আতিয়্যা নুসাইবা বিনতে হারিস আনসারিয়্যা (রা.) নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে একাধিক যুদ্ধে অংশ নেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি আহতদের চিকিৎসা দিতেন, রণাঙ্গন থেকে গুরুতর আহত ও বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করতেন, তৃষ্ণার্তদের পানি পান করাতেন, শহীদদের লাশ মদিনায় নিয়ে যেতেন। (আল কামিল : ২/৭৭)

মহানবী (সা.) তাঁর পরিবার ও সাহাবিদের চিকিৎসাশাস্ত্র চর্চার ফলে মুসলিম সভ্যতায় চিকিৎসা একটি গতিশীল বিদ্যায় পরিণত হয়। মার্কিন লেখক জোসেফ ক্যাম্পবেল লেখেন, ‘আরবরা (মুসলিমরা) চিকিৎসাশাস্ত্রকে একটি সাধারণ পেশা থেকে উন্নীত করে জ্ঞানভিত্তিক উচ্চতর পেশার মর্যাদায় আসীন করে। তারাই চিকিৎসাশাস্ত্রের বইগুলোতে সর্বপ্রথম চিত্র সংযুক্ত করে এবং এ ক্ষেত্রে সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতি প্রবর্তন করে। তারা চিকিৎসায় প্রয়োগযোগ্য রসায়নবিদ্যার উন্নয়ন করে এবং বিভিন্ন প্রকারের ওষুধ উদ্ভাবন করে।

আরবরাই চিকিৎসাশাস্ত্রে প্রবেশের জন্য যোগ্যতা যাচাইয়ের নিয়ম চালু করে। তারা আইন প্রয়োগের মাধ্যমে বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণের বিধান করে। হাসপাতালের ধারণা পৃথিবীতে পূর্ব থেকে প্রচলিত থাকলেও এর পরিবেশ ও ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখে তারা। (অ্যারাবিয়ান মেডিসিন অ্যান্ড ইটস ইনফ্লুয়েন্স অন দ্য মিডল এজেস, পৃষ্ঠা-১৩)

Categories: ধর্ম
Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings