X

ঋণের টাকায় ইউসুফের দিনবদলের স্বপ্ন পুড়ে ছাই

দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে আসছিলেন মো. ইউসুফ। দিনবদলের আশায় জমানো টাকা আর ‍৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে ওই ট্রাকস্ট্যান্ডেই মাস তিনেক আগে পার্টসের দোকান দেন। দিনও ভালো যাচ্ছিল। পার্টস বিক্রির পাশাপাশির মেকানিকের কাজও করে যাচ্ছিলেন ইউসুফ। কিন্তু আকস্মিক আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার দোকানের সব মালামাল।

রোববার (১২ জানুয়ারি) সকাল ৮টা ৫ মিনিটের দিকে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে গাড়ির গ্যারেজে আগুন লাগার খবর পায় ফায়ার সার্ভিস। তিনটি ইউনিটের চেষ্টায় সকাল ৮টা ৩৩ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুড়ে যায় গ্যারেজে পার্কিং করা ছয়টি যানবাহন। পুড়ে ছাই হয়ে যায় রেললাইন ঘেঁষা গ্যারেজের সামনের ১২টি দোকান। পুড়ে যাওয়া দোকানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ।

রোববার তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত দোকানের মালিক-কর্মচারীরা যতটুকু সম্ভব মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করছেন। ছাই সরিয়ে দেখছেন অবশিষ্ট কিছু বেঁচে গেছে কি না। কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন, কেউবা চেষ্টায় আছেন মেরামত করে ঘুরে দাঁড়ানোর।

আরও দেখা যায়, ছয়টি ট্রাক, পিকআপ ও লরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আগুনে। এর মধ্যে তিনটি যানবাহনের ইঞ্জিন একদম পুড়ে গেছে। আগুনে সব হারিয়ে মানবিক বিপর্যয়ে পড়েছেন দোকান মালিকরা।

দোকানের কর্মচারীরা জানান, সকালে অধিকাংশ দোকানে কেউ ছিল না। আকস্মিক আগুনে পাশাপাশি ১২টি দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ইউসুফ মোটরস পার্টস নামের দোকানটি। এটির প্রায় ১২ লাখ টাকার মতো মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।

ইউসুফ মোটরস পার্টসের মালিক ইউসুফ বলেন, ‘বহুত স্বপ্ন নিয়া, আশা করে দোকানডা দিছিলাম। এখনো ঋণ ৫ লাখ টাকা, আবার বাকি-বুকি করে মালামালও তুলছি দোকানে। সব পুড়ে গেছে। আগুনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আইসা দেখি পাশের দোকান জ্বলতাছে। ভাবছিলাম নিজের দোকান যাক মালামালগুলো রক্ষা করতে পারব। ভেতরে ঢুকে দেখি সব জ্বলতাছে। জান নিয়া বাইরে আইসা পড়ছি।’

তিনি বলেন, ‘মাত্র তিন মাস আগে দোকানটা নিছি। দুটা কর্মচারী ছিল। দোকানে বিভিন্ন গাড়ির মালামাল বেচাকেনা করি। ভাগ্যে ছিল না ভাই। কি বলব? স্বপ্ন পূরণ তো দূরে এখন বাকি-বকেয়া, আনা মালামালের টাকা আর ঋণের পাঁচ লাখ টাকা কেমনে পরিশোধ করব সেটাই বড় চিন্তার।’

আরেক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী সিদ্দিক। ছোট্ট একটি দোকানে অর্ধশতাধিক ব্যাটারি ছিল যানবাহনের। কোনোটা চার্জের জন্য দোকানে ভাড়া দেওয়া, কোনোটা মেরামতের জন্য, আবার কোনোটা ছিল বিক্রির জন্য রাখা। আগুনে সবই পুড়ে ছাই হয়েছে।

আক্ষেপ করে সিদ্দিক বলেন, ‘আমি কি জরিমানা দেব সেটাই ভাবতাছি। দোকানের তো কিছু নাই। সব তো পুড়ে ছাই হয়ে ফায়ার সার্ভিসের ছিটানো পানিতে মিশে গেছে মাটিতে।’

তিনি বলেন, ‘কাল (শনিবার) অনেক রাত কাম করছি। ভোরে বাসায় গেছি রেস্টের জন্য। সকাল পৌনে ৮টার দিকে খবর পাই আগুন লাগছে। আইসা দেখি আগুন আর আগুন। আগুন যে নেভামু সে অবস্থাও ছিল না। আমি ভাই ব্যাটারি তৈরি, বিক্রি, মেরামত করি। সব তো গেছে। দোকানের কাজের সব সরঞ্জামাদি পুড়ে গেছে।’

এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আগুন লাগাইছে নাকি লাগছে কেমনে কমু। মাল গেছে আমার, ইমান গেছে আমার। এখন আমি কারে দোষ দিমু। সেটা জানলে তো তাকে ধরতেই পারতাম। খালি শুনছি পেছন থেকে আগুন লাগছে।’

চা পাতা, রুটি-বিড়ি সব পানি-আগুনে মাটিতে মিশে গেছে জামালের

ভাইয়ের দোকানের সামনে ৫ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে গত শুক্রবার থেকে চা, কলা, রুটি আর বিড়ি-সিগারেট বিক্রি করতেন জামাল হোসেন। ভাইয়ের দোকানের সঙ্গে সঙ্গে সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার।

জামাল হোসেন বলেন, ‘আমি কাল (শনিবার) রাত ৯টার সময় এখান থেকে গেছি। যাওয়ার আগে ১১ হাজার ৩০০ টাকার সিগারেট, দুধ, চিনি, চা পাতাসহ আনুষঙ্গিক সব কিনে দিয়ে গেছি আজকে (রোববার) চালানোর জন্য। সকালে ছেলে এসে দোকান চালানোর কথা। সকালে ছেলে ফোন করে বলে আব্বা সব শ্যাষ।’

তিনি বলেন, ‘আমার চা দোকান শ্যাষ, মেজো ভাইয়ের গ্যারেজ শ্যাষ। খুব অসহায় লাগছে। সব জ্বলে ছাই হয়ে গেছে, একটা সুতোও পাই নাই। তিন মাস আগে দোকান শুরু করেই অসুস্থ হয়ে পড়ি। সুস্থ হয়ে গত শুক্রবার আবার এখানে দোকান শুরু করি। মাত্র দুদিন দোকানদারি শুরু করছি ভাই, আজ সব শ্যাষ। কি করমু, কি খামু ভাইবা পাইতাছি না।’

আগুনের কারণ কী হতে পারে– জানতে চাইলে জামাল বলেন, ‘এটা সরকারি জায়গা। যার যখন ক্ষমতা তখন সে ভোগদখল করে, ভাড়া দেয়। কারণ একটা হতে পারে ভোগ-দখলের রাজনীতি। আবার এখানে পেছনে মাদক-জুয়ার আসর বসে। নিয়মিত রাতে আড্ডা বসে। সেখান থেকে কেউ যাওয়ার পথে ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আগুন দিয়ে যেতে পারে।’

এই চা দোকানি বলেন, ‘যেটাই হোক ক্ষতি তো ভাই আমার। আমরা সন্দেহ করতে পারব। কিন্তু কাউকে ধরতে পারব না। আমাদের হয়ত এটাই নসিবে ছিল।’

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সহ সভাপতি খবির উদ্দিন আহমেদ বলেন, ট্রাকস্ট্যান্ড দীর্ঘদিন ধরে আমরা তিনটা সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করছি। কিন্তু সেটা অপরিকল্পিত। আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হোক এই ট্রাকস্ট্যান্ড। কিন্তু সরকার কিছুই করছে না।

তিনি বলেন, আমাদের দাবি, এটা পরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করা হোক। যেখানে পানির লাইন থাকবে, পর্যাপ্ত গাড়ি রাখার জায়গা থাকবে। বহুতল গ্যারেজ হোক। সরকার টিঅ্যান্ডটি কলোনির মাঠের ওখানে জায়গা দেবে বলেছে, সরকার কিন্তু এখনো দেয়নি। ওটা হলে এখানকার সব সমস্যার সমাধান হবে।

Categories: জাতীয়
Main Admin:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings