X

ঋণ গ্রহণের ইসলামী নীতিমালা

মানুষের জীবনে এমন অনেক মুহূর্ত আসে, যখন আর্থিক সংকটে পড়ে কেউ কারো সাহায্য নেওয়া ছাড়া সামনে আগানোর উপায় থকে না। এই সহযোগিতার একটি রূপ হলো ঋণ। তবে ইসলাম ঋণকে হালকাভাবে নেয়নি। এটি একদিকে যেমন কারো উপকারের মাধ্যম, তেমনি দায়িত্ব ও পরিণতির দিক থেকেও অত্যন্ত গম্ভীর এক বিষয়।

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ঋণ গ্রহণ ও প্রদান, উভয়ের জন্যই কিছু গুরুত্বপূর্ণ আদব ও বিধান রয়েছে। লেনদেনের শুদ্ধতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে, কারণ এটি পরকালের মুক্তির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত।

যদি কারো আমলনামায় ইবাদতের নেকি থাকে, কিন্তু মানুষের হক নষ্ট করার গুনাহও থাকে, তাহলে জান্নাত ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন কঠিন হয়ে যাবে। এমনকি কেউ যদি নিজের প্রাণকে আল্লাহর রাস্তায় কোরবানিও করে দেয়, আবার বারবার শহীদের মর্যাদা অর্জন করে, তবু যদি সে কারো হক আদায় না করে থাকে, যা তার ওপর ফরজ ছিল, তাহলে সে জান্নাতের নিয়ামত থেকে বঞ্চিত থাকবে, যতক্ষণ না তার ওয়ারিশরা তার পক্ষ থেকে সেই হক আদায় করে দেয়।

নিচে ঋণসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক তুলে ধরা হলো—

১. চরম প্রয়োজন ছাড়া ঋণ গ্রহণ না করা

আমাদের জীবনে কিছু জিনিস মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, আর কিছু জিনিস আমাদের ইচ্ছা বা খায়েশের সঙ্গে সম্পর্কিত। মানুষের উচিত তার স্বভাব এমনভাবে গড়ে তোলা, সে তার প্রয়োজনগুলো মধ্যম পথে পূরণ করার চেষ্টা করে। এ জন্য কখনো কখনো মানুষকে ঋণও নিতে হয়, যা শরিয়তেও অনুমোদিত। তবে ইচ্ছা বা খায়েশের ক্ষেত্রে, কখনো এগুলো জায়েজ ও মুবাহ (অনুমোদিত) হয়, আর কখনো নাজায়েজ ও হারাম হয়।

যেসব ইচ্ছা মুবাহ, সেগুলো নিজের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী পূরণ করতে কোনো সমস্যা নেই এবং এতে গুনাহও হবে না। তবে নাজায়েজ ও হারাম ইচ্ছাগুলো আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও পূরণ করা উচিত নয়, আর ঋণ নিয়ে এগুলো পূরণ করার তো প্রশ্নই ওঠে না।

২.ঋণের লেনদেন লিখে রাখা

শরিয়ত আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ নির্দেশনা প্রদান করেছে। ঋণের লেনদেন লিখে রাখা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা দ্বন্দ্ব এড়াতে এবং হক রক্ষায় সহায়ক। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা একে অপরের কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ঋণের লেনদেন করো, তখন তা লিখে রাখো।’ (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮২)

৩. সুদী ঋণের লেনদেন থেকে বিরত থাকা

সুদ শরিয়তে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ এবং সুদী ঋণের লেনদেন থেকে বিরত থাকার জন্য মুমিনদের প্রতি সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (সা.) সুদ গ্রহণকারী, সুদ দানকারী, সুদের লেনদেন লিখে রাখা ব্যক্তি এবং এর সাক্ষীদের ওপর লানত করেছেন এবং বলেছেন, তারা সবাই গুনাহে সমান অংশীদার। (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৯৪৮)

৪. ঋণ পরিশোধের নিয়ত করা

ঋণ গ্রহণের সময় পরিশোধের দৃঢ় নিয়ত থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, বরং আল্লাহর সাহায্য লাভের মাধ্যম। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মানুষের সম্পদ (ঋণ) গ্রহণ করে এবং পরিশোধের নিয়ত রাখে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেন।’ (বুখারি, হাদিস : ২৩৮৭)

৫.ঋণ পরিশোধে গড়িমসি না করা

ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করা শুধু নৈতিক দায়িত্ব লঙ্ঘনই নয়, বরং এটি শরিয়াহর দৃষ্টিতে জুলুম হিসেবে গণ্য। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, সম্পদশালী ব্যক্তির গড়িমসি করা জুলুম। (বুখারি, হাদিস : ২৪০০)

তাই কোনো ব্যক্তির কাছে ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যদি সে ঋণ পরিশোধ না করে, তবে সে জালিম।

৭. ঋণের দাবি নরমভাবে করা

ঋণের দাবি নরমভাবে করা একটি শরিয়ত নির্দেশ এবং নৈতিক কর্তব্য। এটি শুধু সম্পর্ক সংরক্ষণে সাহায্য করে না, বরং আল্লাহর রহমত ও বরকত আকর্ষণ করে। রাসুল (সা.)-এর নরমতার উদাহরণ আমাদের শিক্ষা দেয়। হজরত জাবির ইবন আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা সেই ব্যক্তির ওপর রহম করেন, যে ব্যক্তি ক্রয়-বিক্রয় এবং ঋণ আদায়ের সময় নরম ব্যবহার করে। (বুখারি, হাদিস : ২০৭৬)

৮. ঋণগ্রহীতাকে সময় দেওয়া

ঋণগ্রহীতা যদি অসচ্ছল হয়, তবে তাকে সময় দেওয়া শরিয়াহের একটি গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ, যা মানবিকতা ও করুণার প্রকাশ ঘটায়। আল্লাহ তাআলা বলেন, যদি ঋণগ্রহীতা অসচ্ছল হয়, তবে তাকে সচ্ছলতা না আসা পর্যন্ত সময় দাও।(সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮০)

এই আয়াতটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ দেয়, ঋণগ্রহীতা যদি আর্থিক সংকটে থাকে, তবে তাকে জোর না করে সচ্ছলতা না আসা পর্যন্ত সময় দেওয়া উচিত। এটি রহম ও ন্যায়বিচারের একটি প্রকাশ।

৯. ঋণ পুরোপুরি বা কিছু অংশ মাফ করে দেওয়া

সামর্থ্য থাকলে ঋণ পুরোপুরি বা কিছু অংশ মাফ করে দেওয়া এটি রহমের প্রকাশ। আল্লাহ তাআলা বলেন, আর যদি (ঋণগ্রহীতাকে) ঋণ সদকা করে দাও (অর্থাৎ পুরোটা মাফ করে দাও বা যতটুকু সম্ভব ততটুকু মাফ করে দাও), তবে এটি তোমাদের জন্য অনেক উত্তম, যদি তোমরা এর গুরুত্ব জানতে। (সুরা : বাকারা, আয়াত : ২৮০)

১০. ঋণগ্রহীতার জন্য পঠিতব্য দোয়া

ঋণগ্রহীতার জন্য একটি বিশেষ দোয়া রয়েছে, যা রাসুলুল্লাহ (সা.) শিখিয়েছেন এবং এটি পড়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ঋণ পরিশোধের সাহায্য প্রার্থনা করা যায়। আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, একজন মুকাতাব (চুক্তিবদ্ধ দাস) তাঁর কাছে এসে বলল, ‘আমি আমার মুক্তির জন্য চুক্তিবদ্ধ অর্থ পরিশোধে অক্ষম হয়ে পড়েছি, আমাকে সাহায্য করুন।’ আলী (রা.) বললেন, ‘আমি কি তোমাকে এমন কিছু কথা শিখিয়ে দেব না, যা আমাকে আল্লাহর রাসুল (সা.) শিখিয়েছিলেন? যদি তোমার ওপর ছবির পাহাড় (তায় কাবিলায় অবস্থিত আরবের একটি বড় পাহাড়) সমান ঋণও থাকে, তবে আল্লাহ তা পরিশোধের ব্যবস্থা করে দেবেন।’

তিনি বললেন, এই দোয়া পড়ো, ‘আল্লাহুম্মাকফিনী বিহালালিকা আন হারামিকা ওয়া আগনিনী বিফাদ্বলিকা আম্মান সিওয়াক।’ অর্থ ‘হে আল্লাহ! হারামের পরিবর্তে তোমার হালাল রুজি আমার জন্য যথেষ্ট করো। আর তোমাকে ছাড়া আমাকে কারো মুখাপেক্ষী কোরো না এবং স্বীয় অনুগ্রহ দ্বারা আমাকে সচ্ছলতা দান করো।’ (জামি তিরমিজি, হাদিস : ৩৫৬৩)

১১. ঋণ পরিশোধের সময় ঋণদাতার জন্য দোয়া

ঋণগ্রহীতা যখন তার দায়িত্ব পূরণ করে, তখন তাকে দোয়া দিয়ে বরকত প্রার্থনা করা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুন্নাহ। ইসমাঈল ইবন ইবরাহিম ইবন আবদুল্লাহ ইবন আবি রবিআ থেকে তাঁর পিতার মাধ্যমে হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবীজি (সা.) আমার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন। এরপর যখন তিনি আমাকে পরিশোধ করলেন, তখন তিনি আমাকে এই দোয়া দিয়েছিলেন, ‘বারাকাল্লাহু লাকা ফি আহলিকা ওয়া মালিকা।’ আল্লাহ তোমার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। (নাসায়ি, হাদিস : ৪৬৮৩)

ঋণ নেওয়া ও দেওয়া, দুটিই দ্বিনের আলোকে পরিচালিত হলে পারস্পরিক ভালোবাসা ও আস্থা গড়ে ওঠে এবং দুনিয়া-আখিরাতে শান্তি আসে। আমাদের উচিত, ঋণ বিষয়ে যত্নশীল হওয়া, সুদের ভয়াবহতা থেকে বাঁচা এবং মানুষের হক আদায়ে সদা সচেষ্ট থাকা।

Categories: ধর্ম
Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings