X

এই সময়ে সেন্ট মার্টিন যেতে যেতে যা দেখবেন

কক্সবাজার শহরের একেবারে শেষ প্রান্তে নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট। সেন্ট মার্টিনে যাত্রার উদ্দেশ্যে সেখানে বাঁকখালী নদীতে অপেক্ষমাণ জাহাজ এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস। পর্যটকেরা অনলাইন নিবন্ধন সম্পন্ন করতে ব্যস্ত। পরে ট্রাভেল পাস নিয়ে সার বেঁধে জাহাজে ওঠেন সাত শতাধিক পর্যটক। এরপর যাত্রা শুরু করে জাহাজটি।

গতকাল রোববার ভোরে দেখা যায় এ চিত্র। জাহাজটি যখন নুনিয়ারছড়া ঘাট ছাড়ে, তখন ভোর ছয়টা। এত সকালে জাহাজ ছাড়ার কারণ, সাগরে তখন জোয়ার। ভাটা পড়ে গেলে বাঁকখালী নদীতে পানি কমে যায়, এ কারণে জাহাজ ঢুকতে পারে না।

বাঁকখালী নদী থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে এমভি কর্ণফুলী এক্সপ্রেস বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে ঢুকে পড়ে। পশ্চিম পাশে সবুজ প্যারাবন, পূর্ব পাশে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য নির্মাণাধীন পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৩৭টি ভবনের খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। জাহাজে পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মীরা পর্যটকদের সঙ্গে পলিথিন ও প্লাস্টিকের বোতল আছে কি না, তল্লাশি করেন। পলিথিন-প্লাস্টিক পেলে তা রেখে দেওয়া হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সেন্ট মার্টিনে পলিথিনের ব্যবহার, প্রবালসহ সামুদ্রিক প্রাণী সংগ্রহ, বারবিকিউ পার্টি ও সৈকতে রাতের বেলা হইচই নিষিদ্ধ করেছে।

মহেশখালী চ্যানেল অতিক্রম করে পশ্চিম দিকে ১০-১৫ কিলোমিটার গেলে গভীর সাগর। এক পাশে কক্সবাজার বিমানবন্দর। উত্তর দিকে সাগরদ্বীপ মহেশখালী উপজেলা। দূর থেকে ২৮৮ ফুট উচ্চতার মৈনাক পর্বত দেখা যায়। পর্বতের চূড়ায় ঐতিহাসিক আদিনাথ মন্দিরও চোখে পড়ে। জাহাজটি যখন এরপর পশ্চিম দিকে ছুটে চলে, পথে দেখা মেলে অসংখ্য গাঙচিলের ওড়াউড়ি আর মাছ ধরার নৌকার ছোটাছুটি।

প্রায় আধা ঘণ্টা পর জাহাজটি পৌঁছায় বঙ্গোপসাগরের সোনাদিয়া চ্যানেলে। সেখান থেকে পূর্ব দিকে ১২৭ কিলোমিটার দূরে গেলেই সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। সকাল ৯টায় জাহাজটি উখিয়া উপকূলের কাছাকাছি চলে আসে। জাহাজের অগ্রভাগে গোল করে বসে বেশ কয়েকজন তরুণ তাস খেলছিলেন।

জাহাজে থাকা পর্যটকদের একজন সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ী হুমায়ূন কবির (৪০)। তিনি বলেন, জীবনে প্রথমবারের মতো তিনি সেন্ট মার্টিনে যাচ্ছেন। কিন্তু গভীর সমুদ্র দিয়ে ছয়-সাত ঘণ্টার পথ তাঁর ভালো লাগছে না। এর একটি কারণ গভীর সাগর দিয়ে জাহাজ চলাচলের সময় মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকমতো পাওয়া যায় না। পাশে থাকা আনছার হোসেন নামের একজন বলেন, তিনি টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে দ্বীপটি ভ্রমণে গেছেন অনেকবার। এবার গভীর বঙ্গোপসাগর দিয়ে যাচ্ছেন। টেকনাফ থেকে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের মজাই আলাদা। নাফ নদীর দুই পাশে প্যারাবন, গাঙচিলের ওড়াউড়ি, নৌকার মাছ ধরার দৃশ্য আনন্দদায়ক।

কক্সবাজার সৈকত, হিমছড়ি ও ইনানী সৈকত পেছনে ফেলে সকাল সাড়ে ১০টায় জাহাজটি পৌঁছে যায় টেকনাফ উপকূলের কাছাকাছি। তখনো সেন্ট মার্টিন আরও আড়াই ঘণ্টার পথ। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে জাহাজ পৌঁছায় সাবরাং এলাকার কাছাকাছি। জাহাজের লোকজন জানান, আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন সেন্ট মার্টিন।

দুপুর ১২টার দিকে এমভি কর্ণফুলী পৌঁছে যায় শাহপরীর দ্বীপের কাছে। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে সাগরের বুকে দেখা যাচ্ছিল সেন্ট মার্টিন দ্বীপ। দূর থেকে দেখলে মনে হয় মানুষের পায়ের তলার ছাপ। দ্বীপের চারদিকে দাঁড়িয়ে থাকা হাজারো নারকেলগাছ দৃশ্যমান। সাড়ে ১২টার দিকে জাহাজ পৌঁছায় সেন্ট মার্টিন।

সেন্ট মার্টিনের বাসিন্দারা জানান, গত বছরের জানুয়ারি মাসে সেন্ট মার্টিন বাজার ছিল লোকে লোকারণ্য। ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকের কারণে বাজারের ভেতরের রাস্তায় হাঁটা যেত না। এবার পর্যটকের সমাগম কম। বাজারও কিছুটা ফাঁকা। ব্যবসা-বাণিজ্যও মন্দা বলে জানালেন দোকানিরা।

দ্বীপের নানা তথ্য
সেন্ট মার্টিনের স্থানীয় নাম নারিকেল জিনজিরা। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পূর্বাংশে ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের প্রবালসমৃদ্ধ দ্বীপটি অবস্থিত। পর্যটন করপোরেশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, ১৯০০ সালের দিকে ব্রিটিশ ভূজরিপ দল এই দ্বীপকে ব্রিটিশ-ভারতের অংশ হিসেবে গ্রহণ করে। জরিপে সাধু মার্টিনের নামে দ্বীপটির নামকরণ করা হয় সেন্ট মার্টিন।

পরিবেশ ও মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, এই দ্বীপে রয়েছে ১৫৩ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল, ১৫৭ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৬৬ প্রজাতির প্রবাল, ১৫৭ প্রজাতির শামুক-ঝিনুক, ২৪০ প্রজাতির মাছ, ৪ প্রজাতির উভচর ও ২৯ প্রজাতির সরীসৃপ প্রাণী। দ্বীপটির কোমরসমান স্বচ্ছ পানিতে নামলে দেখা মেলে প্রবাল, শৈবাল, শামুক-ঝিনুকসহ অসংখ্য প্রাণীর।

গত কয়েক বছরে দৈনিক ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার মানুষ ভ্রমণ করেছেন দ্বীপটিতে। ৯০ শতাংশের যাতায়াত ঘটে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে। ৩৪ কিলোমিটারের এই নৌপথের মধ্যে ১৭ কিলোমিটার নাফ নদী, অবশিষ্ট ১৭ কিলোমিটার বঙ্গোপসাগর। নাফ নদীর পূর্ব দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য আর পশ্চিম দিকে টেকনাফ। তবে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সংঘাতের কারণে চলতি মৌসুমে টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে।

১ ডিসেম্বর কক্সবাজার শহরের নুনিয়ারছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটিঘাট দিয়ে সেন্ট মার্টিনের জাহাজ চলাচল শুরু হয়। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দৈনিক দুই হাজার পর্যটক সেন্ট মার্টিনে রাত যাপনের সুযোগ পাচ্ছেন। আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ সুযোগ থাকছে। ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সেন্ট মার্টিনে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ হয়ে যাবে।

জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১০) অনুযায়ী সেন্ট মার্টিনকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন (ইসিএ) এলাকা ঘোষণা করা হয়। ২০২২ সালের প্রজ্ঞাপনে সেন্ট মার্টিনকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া ঘোষণা করে সরকার।

Categories: পর্যটন
Main Admin:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings