X

কোমরপানিতে চার দিন কাটিয়ে শেষে ঠাঁই হলো আশ্রয়কেন্দ্রে

নোয়াখালীর ফেনী-চৌমুহনী মহাসড়কের পাশে বেগমগঞ্জ সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির সামনের মাঠ এবং চলাচলের রাস্তা এখনো ডুবে আছে হাঁটুসমান পানিতে। সেই পানি মাড়িয়ে বন্য উপদ্রুত এলাকা থেকে মানুষজন আসছেন। বিদ্যালয়ের দুটি ভবনের ৩০টি কক্ষে পাঁচ দিন ধরে আশ্রয় নিয়েছে তিন শ পরিবার। অস্থায়ী এই আশ্রয়কেন্দ্রের বারান্দায় বন্যার্ত মানুষের জটলা। চোখেমুখে অসহায়ত্বের ছাপ। কক্ষগুলো থেকে আসছে শিশুদের কান্নার শব্দ, কোলাহল। প্রতিটি কক্ষে প্রায় ১০টির মতো পরিবারের ঠাঁই হয়েছে। একটি কক্ষে ঢুকতেই দেখা গেল টুল-বেঞ্চি জোড়া দিয়ে একেকটা পরিবার নিজেদের মতো করে বিছানা তৈরি করে নিয়েছে। তেমনই একটা বিছানায় শিশু কোলে নিয়ে বসেছিলেন দুই সন্তানের মা রহিমা খাতুন (৩০)। জানতে চাই, কীভাবে কোথা থেকে এসেছেন তিনি?

বেগমগঞ্জ উপজেলার গণিপুর গ্রামে থাকেন রহিমা খাতুন। বসতঘরে কোমরসমান পানি রয়েছে এখনো। ঘর ডুবে যাওয়ার পর একটানা চার দিন পরিবারের ১০ সদস্যসহ তিনি কোমরপানিতে কাটিয়েছেন। এর মধ্যে চার মাসের শিশু নুসরাত জাহান জ্বরে আক্রান্ত হয়। পরে বাধ্য হয়ে আধা কিলোমিটার দূরে বেগমগঞ্জ উচ্চবিদ্যালয়ে এসে ওঠেন তাঁরা। কিন্তু এখানে এসেও আছেন বিপদে। বাচ্চাদের ঠিকমতো খাবার দিতে পারছেন না। দুই বেলা রান্না করা খাবার খেতে পেরেছেন চার দিন। এখন কোনোমতে চিড়া, মুড়ি খেয়ে পার করছেন।

গতকাল শনিবার দুপুরে বেগমগঞ্জ আশ্রয়কেন্দ্র রহিমা খাতুনের মতো অনেকের সঙ্গে কথা হয়। সবার গল্পই এক রকম। বন্যা থেকে বাঁচতে বাধ্য হয়ে ঘর ছেড়ে এসেছেন তাঁরা। কারও ডুবেছে মাছের খামার, পুকুর আবার কারও ধানের গোলা। কেউ মাত্র গরু পালন শুরু করেছিলেন। বন্যায় সব শেষ তাঁদের।

রহিমা খাতুনের স্বামী শাহাদত হোসেন পেশায় পাইপ ফিটার মিস্ত্রি। বন্যার কারণে তিনি আজ এক সপ্তাহের বেশি বেকার। অসুস্থ মেয়ের জন্য যে ওষুধ কিনবেন, সেই টাকাও ঘরে ছিল না। রহিমা বলেন, সংসারের উন্নতির কথা ভেবে স্বামীর পরিশ্রমের টাকা এবং ঋণ নিয়ে দুটি গরু কিনেছিলেন। বাড়ির পাশের একজনের জমি ইজারা নিয়ে মাছের খামার করেছেন। খামারের সব মাছ ভেসে গেছে। প্রায় তিন লাখ টাকার মাছ হবে সেখানে। সবই পানিতে গেল। তবে গোয়ালঘরের গরু দুটি নিয়ে এসেছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। কেন্দ্রের বাইরে সে দুটিকে বেঁধে রেখেছেন তিনি। বন্যায় যে ক্ষতি হলো, সেটা পুষিয়ে নিতে অনেক দিন লেগে যাবে। গরুর খাদ্য জোগাড় করাও সম্ভব হবে না। তাই গরুগুলো বিক্রি করে দেবেন বলে জানালেন।

গণিপুর গ্রামের আরও কিছু পরিবার এই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। তাদের অনেকেই বড় ধরনের ক্ষতির শিকার হয়েছে। পরিবারের আয় উন্নতির যে স্বপ্ন ছিল তা অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে। এমন বন্যার কথা তারা কখনো ভাবেনি। গণিপুর গ্রামের সুবিয়া খাতুনও (৬০) এমন পানি দেখেননি কখনো। তিনি বলেন, গণিপুর এমনিতেই নিচু এলাকা। কিন্তু কখনোই বাড়ির উঠানে হাঁটুসমান পানি হয়নি। এবারের বন্যায় বাড়ির উঠানে পানি উঠেছে গলাসমান। আর ঘরের ভেতর কোমরসমান। পানি না নামায় বাধ্য হয়ে তাঁরা আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন।

চারদিকে থই থই পানি হলেও আশ্রয়কেন্দ্রে পানির সংকট তীব্র। গোসল ও পান করার পানি পর্যাপ্ত নেই।

তাই অনেকেই চর্মরোগ ও পেটের অসুখে ভুগছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মারজাহন চৌধুরীর দুই মেয়ের হাতে খোসপাঁচড়া উঠে ভরে গেছে। মারজান চৌমুহনী পৌরসভার করিমপুর এলাকার মুন্সিবাড়ির বাসিন্দা। পরিবারের নয়জন সদস্যকে নিয়ে এই আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। স্বামী রিকশাচালক। সড়কে পানি হওয়ায় তাঁরও আয়রোজগার বন্ধ। হাসপাতাল থেকে আসা চিকিৎসক মেয়েদের দেখে চারটি ট্যাবলেট দিয়েছেন। কিন্তু কোনো উন্নতি হচ্ছে না। চুলকানির কারণে রাতে বাচ্চারা ঘুমাতে পারে না।

বেলা বাড়তে থাকলে খাবার নিয়ে বসে বেশ কয়েকটি পরিবার। খাবার বলতে শুকনো বিস্কুট, চিড়া আর গুড়। অনেকে মুড়ি ভিজিয়ে খাচ্ছিলেন। কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে আসার সময় একজন কাতর কণ্ঠে বললেন, একটু ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করলে অন্তত স্বস্তি মিলত। শুকনো খাবার কত দিন খাওয়া যায়।

Categories: জাতীয়
Main Admin:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings