X

খেলাপি ঋণ আদায়ে গতি ফিরেছে

শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণ আদায়ে জোর দিয়েছে ব্যাংকগুলো। আগের তুলনায় আদায়ও বেড়েছে। ব্যাংকগুলো বলছে নিজ উদ্যোগে গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করেছি। অন্যদিকে সরকারের কঠোর ভূমিকা দেখে বাধ্য হয়ে ঋণ পরিশোধ করছেন অনেকে।

কিন্তু কার্পেটের নিচে লুকানো বিপুল পরিমাণ খেলাপি বেরিয়ে আসার কারণে সার্বিক খেলাপি ঋণে তার প্রভাব লক্ষ করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, নতুন গভর্নর আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ১৪টি ব্যাংকের পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। প্রথম দিকে যাদের বোর্ড পরিবর্তন করা হয়েছে তাদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যাংক এরই মধ্যে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। অর্থাৎ ব্যাংক সংস্কারের ওষুধ কাজ শুরু করেছে।

সঠিক তথ্য বেরিয়ে আসার কারণে কিছু কিছু ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ মাটি থেকে আকাশ ছুঁয়েছে রাতারাতি। সব মিলিয়ে এখন ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ তিন লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা।
মোহাম্মদ আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে নতুন পরিচালনা পর্ষদ নিয়োগ দেওয়ার পর গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাত্র তিন সপ্তাহে ৩৫০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ আদায় করেছে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক (এফএসআইবি), যা ঘুরে দাঁড়ানোর বিস্ময়কর এক ঘটনা বলতে হয়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে শীর্ষ ২০ এবং অন্যান্য খেলাপির কাছ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪১০ কোটি টাকা।

এর বিপরীতে মাত্র ৯৪ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয়েছিল ব্যাংকটি। ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসে খেলাপি থেকে প্রতি মাসে ২৯ কোটি টাকা আদায় করেছিল রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর খেলাপি গ্রাহকের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হয়। ফলে প্রতি মাসেই একটি ভালো অঙ্কের আদায় চলছে। ব্যাংক জানায়, গত জানুয়ারি মাসেই খেলাপি হওয়া ঋণ থেকে ১৪২ কোটি টাকা আদায় করেছে রূপালী ব্যাংক।
শুধু রূপালী নয়, রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য একটি ব্যাংক অগ্রণীরও আদায় কার্যক্রমে গতি লক্ষ করা গেছে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ৬০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল ব্যাংকটি। এর বিপরীতে মাত্র ২১৯ কোটি টাকা আদায় করতে সক্ষম হয় তারা। তবে অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ পুনরুদ্ধার বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত এক হাজার ৭১৪ কোটি টাকা আদায় করেছে ব্যাংকটি।

ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, ‘আমরা প্রত্যেকটি গ্রাহকের সঙ্গে আলাদা আলাদা মিটিং করেছি। কী কী সমস্যা সেগুলো শুনেছি। সমস্যা অনুযায়ী সমাধান দেওয়ার চেষ্টা করেছি। কারো কাছ থেকে ৫ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করে দেওয়া হয়েছে। আবার কারো কাছ থেকে আরো বেশি। আগের সরকারের আমলে ঋণ রিশিডিউল করার জন্য কোনো ডাউন পেমেন্ট দিতে হতো না। এখন অল্প হলেও সেই টাকা দিতে হচ্ছে। এ কারণে আদায় বাড়ছে। আবার যেসব কম্পানি অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপি হয়ে পড়েছে কিন্তু তার উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে, তাদের নতুন করে বিনিয়োগের ব্যবস্থা করেছি। তারাও টাকা ফেরত দিচ্ছে। আর একেবারে নিরুপায় হলে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে। নির্ধারিত প্রক্রিয়া শেষে সম্পদ নিলামে যাবে। এভাবে আমাদের ঋণখেলাপি থেকে আদায়ের পরিমাণ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।’

সরকার পরিবর্তনের পর সবচেয়ে আলোচিত জনতা ব্যাংকও ২০২৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৫৯ কোটি টাকা নগদ আদায় করেছে। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই অঙ্ক খুবই নগণ্য। মাত্র ১৪ শতাংশ। এর পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, আগের তুলনায় তাদের রিকভারির পরিমাণ বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ যেমন বাড়ছে, তেমনি ঋণ আদায়ও বাড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলো বিশেষ উদ্যোগ নেওয়ায় খেলাপি ঋণ আদায় বাড়তে শুরু করেছে। অক্টোবর পর্যন্ত ন্যাশনাল ব্যাংক এক হাজার কোটি টাকা, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক ৯০০ কোটি এবং কমার্স ব্যাংক ২৩৩ কোটি টাকার ঋণ আদায় করেছে। এ ছাড়া জনতা ব্যাংক চট্টগ্রামে খেলাপি ঋণ আদায়ে এস আলম গ্রুপের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালতে মামলা করেছে। ওই সব ঋণ আদায়ে সম্পদ নিলামে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।

এ বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন বলেন, ‘খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রত্যেকটি ব্যাংক যত্নশীল হয়েছে, বিশেষ করে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি করার বিষয়ে। পাশাপাশি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যবস্থা করেছে অনেক ব্যাংক। যার ফলে খেলাপি ঋণ আদায় বেড়েছে। আমানতকারীদের টাকা কেউ ঋণ নিয়ে ফেরত না দিলে সেটা সবার জন্য ক্ষতি। ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত এলে প্রাণের সঞ্চার হয়। তাই করপোরেট সুশাসনের কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি ব্যাংককেই ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে যত্নশীল হওয়া উচিত।’

সম্প্রতি চট্টগ্রামে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে ঋণখেলাপি ২০টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তালিকা জনসমক্ষে তুলে ধরেছেন রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের কাছে ঋণ বাবদ সুদ-আসল মিলিয়ে ব্যাংকটির পাওনা প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। অগ্রণী ব্যাংকের চট্টগ্রাম সার্কেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক আনোয়ারুল হক বলেন, ‘আমরা ব্যাংকের স্টাফরা অসহায় ছিলাম। রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী লোকজন ওপরমহলে তদবির করে, অনেক সময় আমাদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিতে বাধ্য করেছিলেন।’

গত বছরের নভেম্বরে এক সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানোর জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। মাত্র তিন মাসে খেলাপি গ্রাহকদের থেকে আমরা ৯০০ কোটি টাকা আদায় করেছি।’ আর কিছুটা সময় পেলে আদায়ের পরিমাণ বাড়বে বলেও জানান তিনি। তার প্রমাণও পাওয়া যায় ন্যাশনাল ব্যাংকের কার্যক্রমের মাধ্যমে।

firoz:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings