X

গুমের ঘটনায় ব্যক্তির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতিতে ‘পদ্ধতিগত সমস্যা’ হিসেবে দেখছে কমিশন

অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন জানিয়েছে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনাগুলোর পেছনে ব্যক্তিগত অসদাচরণের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতির একটি ‘পদ্ধতিগত সমস্যা’ কাজ করেছে। কমিশনের কাছে এ পর্যন্ত গুম সংক্রান্ত ১,৮০০টি অভিযোগ জমা পড়েছে।

বাসস’র হাতে পাওয়া কমিশনের দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি প্রতীয়মান হচ্ছে, এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল, যেখানে এই ধরনের অপরাধগুলোকে নীরবে প্রশ্রয় দেওয়া হতো। যেসব ব্যক্তি এসব অপরাধ করতেন, তাদের প্রকৃত অর্থে অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হতো না।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুমের ঘটনার তথ্য নথিভুক্ত করেছিল বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। কমিশন এমন সাতটি নথি পর্যালোচনা করেছে, যেগুলোর ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে গুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকার ‘প্রাথমিক সাক্ষ্য প্রমাণ’ পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদন বলছে, এসব গুমের ধরন থেকে স্পষ্ট হয়েছে, এগুলো কোনো ব্যক্তির একক কর্মকাণ্ড ছিল না, বরং বিভিন্ন ইউনিটের একাধিক সদস্য এতে জড়িত ছিলেন।

একইসাথে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব ঘটনায় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল এমনটা ভাবা প্রায় অসম্ভব।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময় ব্যাপক হারে গুমের ঘটনা ঘটলেও পর্যালোচনায় থাকা নথিগুলোতে  ‘গুম’ শব্দটিরও উল্লেখ নেই। নথিগুলোতে বরং বিস্তারিতভাবে লেখা ছিল সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা। এমনকি তাদের আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় সম্পর্কেও লেখা ছিল। এসব নথিতে দুর্নীতি, শৃঙ্খলাভঙ্গ বা অসদাচরণের অভিযোগের মতো বিষয়গুলো থাকলেও গুম বা বিচারবহির্ভূত হত্যার কোনো বিষয় উল্লেখ নেই।

কমিশন পর্যবেক্ষণ করে বলেছে, বাহিনীগুলোর ভেতরে এমন গুরুতর অভিযোগ নিয়ে ‘নীরবতা’ বজায় রাখাটা সম্ভবত একটি বৃহত্তর ‘অপারেশনাল ম্যান্ডেট’-এর অংশ ছিল—যা বাহিনীর অভ্যন্তরে ‘জাতীয় নিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার’ অজুহাতে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হতো।

প্রতিবেদনে একটি উদাহরণও তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে সেনাবাহিনী থেকে র‌্যাবে আসা এক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিশনের কাছে গুমে জড়িত থাকার ‘প্রাথমিক সাক্ষ্যপ্রমাণ’ রয়েছে। অথচ সেই সময় র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ তাকে একজন ‘অত্যন্ত দক্ষ কর্মকর্তা’ বলে  প্রশংসা করেন।

র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ পরে পুলিশের মহাপরিদর্শক হন। তিনি তার সুপারিশপত্রে ওই কর্মকর্তার কর্মদক্ষতাকে ‘খুব সন্তোষজনক’ এবং নেতৃত্বগুণকে ‘উচ্চমানের’ হিসেবে বর্ণনা করেন। বেনজীর তাকে ব্যক্তিগতভাবে ‘ভদ্র ও সৎ’ এবং পেশাগতভাবে ‘অত্যন্ত দক্ষ ও স্ব-উদ্যোগী’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

তৎকালীন র‌্যাব প্রধান লেখেন, চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে উগ্রপন্থী, সন্ত্রাসবাদ, চোরাচালান ও মাদকচক্র দমনে অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন ওই কর্মকর্তা এবং তার সম্পর্কে ‘কোনো নেতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়নি’।

কমিশন বলছে, সেই প্রেক্ষাপটে তাদের দ্বারা সংঘটিত অপরাধগুলোকে ‘অপরাধ’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রিপোর্ট করা কারো কাছে স্বাভাবিক মনে হতো না।  ‘প্রাতিষ্ঠানিক অগ্রাধিকার ও প্রচলিত মানদণ্ডগুলো কী রেকর্ড হবে আর কী হবে না—তা নির্ধারণ করে দেয়’- এটাই তার প্রতিফলন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, একজন জ্যেষ্ঠ জেনারেল কমিশনকে জানান, তিনি চেষ্টা করেছিলেন সেনাবাহিনী থেকে প্রেষণে র‌্যাবে আসা কর্মকর্তারা যাতে মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধে জড়িয়ে না পড়েন। ব্রিফিং ও ডিব্রিফিংয়ের একটি প্রক্রিয়ার আওতায় এই কর্মকর্তাদের সতর্ক করা হতো যেন তঁরা নিরস্ত্র মানুষদের বেআইনিভাবে হত্যা না করেন।

একটি ঘটনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, এমনই এক ব্রিফিং পর্বে র‌্যাব থেকে ইউনিটে ফিরে আসা এক জুনিয়র কর্মকর্তাকে তার ঊর্ধ্বতন জিজ্ঞেস করেন, তিনি সেখানে কাউকে হত্যা করেছেন কিনা, করলে কতজনকে করেছেন।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওই কর্মকর্তা তা বলতে কিছুক্ষণ দ্বিধা করেন, পরে স্বীকার করেন তিনি ব্যক্তিগতভাবে দু’জনকে হত্যা করেছেন এবং আরও চারজনের হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করেছেন।

কমিশন জানায়, যেহেতু এসব ঘটনার পর টাকা বিতরণ করা হতো, তাই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরে জানতে চান, তিনি ‘অপারেশনের’ পর পাওয়া টাকা কী করেছেন। তখন ওই কর্মকর্তা জবাব দেন, তিনি টাকাটা গ্রামের মসজিদে দান করেছেন।

আরেকটি ঘটনায়, একজন সিনিয়র কর্মকর্তা বর্ণনা করেন, কীভাবে একজন অধস্তন কর্মকর্তা গুমসহ গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়ার পর ধর্ম ভীরুতা অবলম্বন শুরু করেন। তখন ওই সিনিয়র কর্মকর্তা তাকে বলেন, এখন আপনি যে নামাজ পড়েন, তা আল্লাহর হক। কিন্তু যেসব অপরাধ করেছেন, সেগুলো মানুষের হক। আর অন্যের হক নষ্ট করার পাপ আল্লাহ মাফ করেন না।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি এক ধরনের অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রকাশ করে- যেখানে তিনি বুঝতে পারছিলেন তিনি ভুল করেছেন, কিন্তু পরিস্থিতি বা কাঠামোর চাপে সেটা এড়িয়ে যেতে পারছেন না, আবার পুরোপুরি মেনে নিয়েও স্বস্তিতে থাকতে পারছেন না। এটি তার নিজ কর্মের ভার বহনের মানসিক দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে।

কমিশন উল্লেখ করেছে, দুইটি ঘটনার মধ্যে প্রথমটিতে সবচেয়ে দৃষ্টিকটূ বিষয় ছিল—একজন সিনিয়র জেনারেল যখন তার জুনিয়র কর্মকর্তার মুখে ঠাণ্ডা মাথায় দু’জনকে হত্যার স্বীকারোক্তি শোনেন, তখন তিনি কোনো তদন্ত শুরু করেননি, নিহতদের পরিচয় জানার চেষ্টা করেননি কিংবা বিষয়টি সামরিক বা বেসামরিক বিচারপ্রক্রিয়ার আওতায় আনেননি। তার সামনে সব সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং, এই ঘটনাটিকে তিনি তার সতর্কতার উদাহরণ হিসেবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন- যেন ডিব্রিফিং প্রক্রিয়াটিই তার দায়িত্ব পালন করে দিয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সততা, শৃঙ্খলা ও প্রাতিষ্ঠানিক মানদণ্ডে অটল থাকার জন্য পরিচিত একজন সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা র‌্যাবে তার অধীনস্থ কর্মকর্তাদের নিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তবে তার এই উদ্বেগ  হত্যাকাণ্ড বা ভুক্তভোগীদের পরিণতি নিয়ে ছিল না।

কমিশন বলছে, তরুণ কর্মকর্তারা অনেক সময় এসব এড়াতে নিজেদের ‘অক্ষম ও অসহায়’ বোধ করতেন। এক ঘটনায় একজন সেনা সদস্য জানান, র‌্যাবের ইন্টেলিজেন্স সেফ হাউস থেকে আটককৃত এক ব্যক্তি পালিয়ে যান, কিন্তু তিনি তাকে আবার ধরে আনেন। কাছে থাকা একজন তরুণ কর্মকর্তা তখন কাঁপছিলেন, কারণ তিনি ভয় পাচ্ছিলেন- যদি ওই আটক ব্যক্তি পালিয়ে যেতেন, তাহলে প্রতিশোধ হিসেবে তাকে তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হত্যা করতে পারতেন বা গুরুতরভাবে শাস্তি দিতে পারতেন।

কারণ ওই সিনিয়র কর্মকর্তা এমন নিষ্ঠুরতার জন্য পরিচিত ছিলেন।

আরেক বিবরণে একজন কর্মকর্তা বলেন, গুম ও অন্যান্য বেআইনি কর্মকাণ্ডে গভীরভাবে জড়িয়ে পড়া তার এক সহকর্মী বলেছেন, ‘শুরুতে না বলার সাহস ছিল না, এখন তো আর পিছিয়ে যাওয়ার পথ নেই’।

গুম সংক্রান্ত কমিশন বলছে, এসব সাক্ষ্য শুধু ভয়ভীতির পরিবেশকেই তুলে ধরে না, বরং জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতারও পরিচয় তুলে ধরে- যারা কোনো ধরনের নৈতিক সহায়তা বা মানসিক সমর্থন দেননি। সূত্র: বাসস

Categories: জাতীয়
Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings