ফরাসি টায়ার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মিশেলিনের প্রধান নির্বাহী ফ্লোরেন্ট মেনেগক্স বলেন, ‘একটি জিনিস একেবারে হওয়া উচিত না, তা হলো চাকা পাংচার।’
২০১২ সালে মঙ্গলে অবতরণকারী নাসার রোবট ‘কিউরিওসিটি’ এই চ্যালেঞ্জের বাস্তব উদাহরণ। অবতরণের এক বছরের মধ্যে এর ছয়টি অ্যালুমিনিয়াম টায়ারে ছিদ্র ও ফাটল দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের আর্টেমিস মিশনের লক্ষ্য ২০২৭ সালের মধ্যে নভোচারীদের চাঁদে পাঠানো। পরবর্তী আর্টেমিস মিশনগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে হবে। ‘আর্টেমিস-৫’ মিশনে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অনুসন্ধানের জন্য একটি চন্দ্র রোভার ব্যবহার করার পরিকল্পনা করা হয়েছে।
অ্যাপোলোর নভোচারীরা ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ সালের মধ্যে ছয়বার অবতরণ করেন চাঁদের পৃষ্ঠে। তবে সেই সময় যাত্রা সীমিত ছিল প্রায় ৪০ কিলোমিটারের মধ্যে।
মিশেলিনের ‘লুনার এয়ারলেস হুইল’ প্রোগ্রামের প্রধান সিলভাইন বারথেট বলেন, ‘লক্ষ্য হলো ১০ বছরে ১০ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করা।’ নাসার জন গ্লেন রিসার্চ সেন্টারের প্রকৌশলী ড. সান্তো পাডুলা বলেন, ‘আমরা স্বল্প সময়ের জন্য, সপ্তাহব্যাপী ব্যবহারের কথা বলছি না, বরং কয়েক দশকের ব্যবহারের কথা বলছি।’
চাঁদের প্রযুক্তির উদ্ভাবনের বড় চ্যালেঞ্জ হলো সেখানকার চরম তাপমাত্রা। চাঁদের মেরু অঞ্চলে তাপমাত্রা মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে যেতে পারে, যা পরম শূন্য তাপমাত্রার কাছাকাছি। এটি টায়ারের জন্য একটি বড় সমস্যা। এই পরিস্থিতিতে রাবারজাতীয় পদার্থের স্থিতিস্থাপকতা থাকে না। ফলে প্রচলিত টায়ার টিকবে না।
ড. পাডুলা ব্যাখ্যা করেন, ‘পরমাণুর গতি না থাকলে উপাদানের বিকৃতি এবং স্থিতিস্থাপকতা বজায় রাখা কঠিন।’ টায়ারগুলোকে পাথর অতিক্রম করার সময় আকার পরিবর্তন করে আবার আগের আকারে ফিরে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘যদি আমরা স্থায়ীভাবে একটি টায়ারকে বিকৃত করি, তবে এটি সঠিকভাবে ঘুরবে না এবং শক্তির অপচয় হবে।’
এ ছাড়া ভবিষ্যতের যানগুলো আরও ভারী ও বড় হবে, যার জন্য আরও শক্তিশালী চাকার প্রয়োজন। মঙ্গলে এই সমস্যা আরও প্রকট হবে, যেখানে মাধ্যাকর্ষণ চাঁদের দ্বিগুণ।
অ্যাপোলো যুগে ব্যবহৃত রোভারগুলোর চাকা তৈরি হয়েছিল দস্তা দিয়ে মোড়ানো পিয়ানো তারের জাল দিয়ে, যা ৩৫ কিলোমিটার পর্যন্ত চলতে পারত। চরম তাপমাত্রা এবং মহাজাগতিক রশ্মি রাবারকে ভেঙে ফেলে বা ভঙ্গুর কাচের মতো করে তোলে। তাই এখন ধাতব সংকর ও উচ্চ কার্যকারিতাসম্পন্ন প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হচ্ছে এয়ারলেস চাকা।
ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সির (ইএসএ) রোজালিন্ড ফ্র্যাংকলিন মিশনের টিম লিডার পিয়েত্রো বাগলিয়ন বলেন, ‘সাধারণত ধাতব অথবা কার্বন ফাইবারভিত্তিক উপকরণ এই চাকাগুলোর জন্য ব্যবহৃত হয়।’ ২০২৮ সালের মধ্যে এই মিশনে মঙ্গল গ্রহে নিজস্ব রোভার পাঠানোর লক্ষ্য রয়েছে।
একটি উদ্ভাবনী পদার্থ হলো ‘নাইটিনল’, যা নিকেল এবং টাইটানিয়ামের একটি সংকর। দ্য স্মার্ট টায়ার কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আর্ল প্যাট্রিক কোল বলেন, ‘এই দুটিকে একত্রিত করলে রাবারের মতো নমনীয় ধাতু তৈরি হয়, যা বিভিন্ন দিকে বাঁকতে পারে এবং সর্বদা আবার আসল আকারে ফিরে আসে।’ তিনি নাইটিনলের নমনীয়তাকে দেখা সবচেয়ে অবিশ্বাস্য জিনিসগুলোর মধ্যে একটি বলে অভিহিত করেন। এটি তাপ ও ঠাণ্ডার প্রয়োগেও শক্তি শোষণ ও নির্গত করতে পারে। এমনকি এটি হিটিং ও রেফ্রিজারেশনের ক্ষেত্রেও সমাধান দিতে পারে।
মিশেলিনের বারথেট মনে করেন, চাঁদে দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে নাইটিনলের চেয়ে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ বেশি উপযোগী হবে।
অন্যদিকে, জাপানি টায়ার নির্মাতা ব্রিজস্টোন বেছে নিয়েছে প্রাণী অনুকরণ পদ্ধতি। তারা উটের পায়ের গঠন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি করছে অনুভূমিক ধরনের চাকা। এতে স্পোক বা ধাতব পাতাগুলো নমনীয়ভাবে বেঁকে রোভারকে চাঁদের ধূলিময় পাথুরে পৃষ্ঠে আটকে না গিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
মিশেলিন, ব্রিজস্টোন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভেঞ্চুরি অ্যাস্ট্রোল্যাবসহ একাধিক সংস্থা চলতি মে মাসে নাসার জন গ্লেন রিসার্চ সেন্টারে তাদের প্রযুক্তি উপস্থাপন করেছে। বছরের শেষ নাগাদ নাসা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা হয়তো একটি প্রস্তাব বেছে নিতে পারে অথবা একাধিক প্রস্তাবের উপাদান গ্রহণ করতে পারে।
এদিকে ফ্রান্সের এক আগ্নেয়গিরির ধূলিময় এলাকায় মিশেলিন তাদের চাকা পরীক্ষা করছে। ব্রিজস্টোন পরীক্ষা চালাচ্ছে জাপানের তোত্তোরি বালিয়াড়িতে। ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সিও নিজস্ব রোভার নির্মাণের পরিকল্পনা করছে।
চাঁদের জন্য তৈরি হওয়া এই প্রযুক্তির ব্যবহার হতে পারে পৃথিবীতেও। নাইটিনল দিয়ে তৈরি বাইসাইকেলের টায়ার শিগগিরই বাজারে আসছে। দাম তুলনামূলক বেশি হলেও টেকসই হবে অনেক। এবার লক্ষ্য মোটরসাইকেলের জন্যও এমন চাকা তৈরি করা, বিশেষ করে দুর্গম ও পাথুরে এলাকায় ব্যবহারের উপযোগী করে। সূত্র : বিবিসি