ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দিন রাজধানীর চাঁনখারপুলে আনাসসহ ছয়জনকে হত্যার মামলায় আট আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
সোমবার শুনানির সময় কারাবন্দি চার আসামি হাজির ছিলেন। তারা হলেন শাহবাগ থানার সাবেক পুলিশ পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল মো. সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন ও কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম। তাদের সকালে কারাগার থেকে এনে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।
শুনানিতে আসামিদের উদ্দেশে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পড়ে শোনানো হয়। ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নের উত্তরে উপস্থিত চার আসামি নিজেদের নির্দোষ দাবি করেন। ট্রাইব্যুনাল প্রথমে শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেনকে বলেন, ‘গত বছরের ৫ আগস্ট দুপুরে চানখাঁরপুল এলাকায় আদিষ্ট হয়ে আপনি আপনার অধীন যারা ছিলেন, তাদের চায়নিজ রাইফেল ও শটগান দিয়ে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা স্বীকার করেন কি না?’
উত্তরে আরশাদ হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সত্য নয়। সেদিন আমার ডিউটি ছিল শাহবাগ এলাকায় সেনাবাহিনীর সঙ্গে। তা ছাড়া কাউকে গুলি করার নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার আমার ছিল না।’ একই ধরনের প্রশ্নের উত্তরে কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম নিজেদের সম্পূর্ণ নির্দোষ দাবি করেন।
মামলার শুরু থেকেই পলাতক থাকা চার আসামি হলেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম ও রমনা অঞ্চলের সাবেক সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল।
গত বছরের ১ জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে শুরু হওয়া আন্দোলন একপর্যায়ে সহিংস হয়ে ওঠে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের মধ্যে ৫ আগস্ট পতন ঘটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছর শাসনের। সরকারি হিসাবে এই আন্দোলনে আট শতাধিক মানুষের প্রাণহানি হয়েছে এবং ওই সব ঘটনার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। ফলে হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে একের পর অভিযোগ দাখিল হতে থাকে।
এরই ধারাবাহিকতায় জুলাই অভ্যুত্থানের সময় চাঁনখারপুলে ৬ জনকে হত্যার অভিযোগে গত বছরের ২ অক্টোবর ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের কাছে একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগ দায়ের করেন হত্যার শিকার আনাসের বাবা পলাশ।
তদন্ত শেষে গত ২১ এপ্রিল পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রসিকিউশনের কাছে পেশ করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। প্রতিবেদনটি যাচাই ও পর্যালোচনা শেষে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে ২৫ মে ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিকভাবে চার্জশিট (ফরমাল চার্জ) দাখিল করে প্রসিকিউশন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে ছয়জনকে হত্যা করেন অপর আসামিরা।
৯০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে দালিলিক তথ্য-প্রমাণও সংযুক্ত করা হয়। এতে রয়েছে ৭৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি, ঘটনার ১৯টি ভিডিও ক্লিপ, ১১টি পত্রিকার প্রতিবেদন, দুটি ভয়েস কলের অডিও রেকর্ড। এর মধ্যে একটি ভয়েস কল হাবিবুর রহমানের। তিনি পুলিশ কমান্ড সেন্টার থেকে ওয়ারলেসের মাধ্যমে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে দমাতে চায়নিজ রাইফেল দিয়ে সরাসরি গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। এই নির্দেশের পরই প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছেন পুলিশ সদস্যরা। প্রতিবেদনে ১১টি বই দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘটনায় জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন, হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনও রয়েছে। হত্যার শিকার ছয়জনের ছয়টি ডেথ সার্টিফিকেট দাখিল করা হয়। অভিযোগ দাখিলের দিনেই তা আমলে নেন ট্রাইব্যুনাল। এর পর গত ৩ জুন পলাতক চার আসামিকে হাজির হওয়ার নির্দেশ বিজ্ঞপ্তি আকারে পত্রিকায় প্রকাশের আদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।