X

চারদিনের ডেঙ্গুতেই রিফাহ’র মৃত্যু, ‘তছনছ’ রায়হানের সংসার

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ধানমন্ডি প্রভাতি শাখার তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাহ নানজিবা। গত ২২ নভেম্বর (শুক্রবার) হঠাৎ করেই জ্বরে আক্রান্ত হয় সে। পরিবার শুরুতে সাধারণ ভাইরাস জ্বর ভাবলেও পরদিনই ডেঙ্গু পরীক্ষা করানো হয় তাকে, তবে সেই পরীক্ষায় ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করলেও মাত্র চারদিনের ডেঙ্গু শেষে পরের দিনের সকালের আলো ফোটার আগেই নিভে যায় শিশু রিফাহ’র জীবনের আলো।

অকালে আদরের সন্তানকে হারিয়ে যেন তছনছ বাবা রায়হানের ছোট্ট সংসার।

গত ২৬ নভেম্বর রাজধানীর আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রিফাহ নানজিবার মৃত্যু হয়।

তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাহ নানজিবা সুন্দর ছবি আঁকত। এমনকি নামাজ-তসবিহ পড়ায়ও নিয়মিত ছিলো ছোট্ট এই শিশু। ক্লাসে পড়াশোনায় ছিলো ভালো। সবমিলিয়ে সুন্দর আর চঞ্চল মেয়েটিকে বাবা সবসময় ডাকতেন ‘পরী’ বলে। তবে চারদিনের ডেঙ্গুতেই রিফাহ’র এমন মৃত্যুর হিসেব মিলাতে পারছে না কেউই। পরিবার থেকে আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকের একই প্রশ্ন- ‘এত দ্রুতই কেন চলে যেতে হলো আদরের ছোট্ট রিফাহকে?’

ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া শিশু রিফাহ’র বাবার নাম রায়হানুল হক। তিনি সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের এটুআইয়ের একজন কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করছেন। মেয়ের মৃত্যু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে তার জ্বর আসে। শনিবারেই আমি টেস্ট করাই তখন তার ডেঙ্গু পজেটিভ আসে। তখন ডাক্তারকে রিপোর্ট দেখানোর পর হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করার পরামর্শ দেন। কারণ তখন তার প্রেসার ফল (কমে যাচ্ছিলো) করছিল। এরপর হাসপাতালে (শ্যামলী শিশু হাসপাতাল) নিয়ে যাওয়ার পর স্যালাইন দিলে রোববার রাত পর্যন্ত তার প্রেসার ভালো ছিল।

রায়হানুল হক বলেন, স্যালাইনে সাময়িকভাবে প্রেসার ভালো হলেও তখন আবার তার ইউরিন (প্রস্রাব) হচ্ছিল না। ডাক্তার বলেছিল যে তার ইউরিন হওয়া খুব জরুরি। তখন ডাক্তার ইউরিন বাড়ানোর জন্য মেডিসিন দেয়। এভাবে রোববার দিনটা মোটামুটি তার ভালো যায়। এরপর সোমবার সকাল সাতটা থেকে তার প্রেশারটা আবার নামতে শুরু করে। তখন ডাক্তার আমাদেরকে জানায় তাকে আইসিইউতে নিতে হবে। তখন শিশু হাসপাতালে আইসিইউ ফাঁকা ছিল না, তাই তাকে দ্রুতই আনোয়ার খান মর্ডান মেডিকেলে যাই এবং সেখানে আইসিইউতে ভর্তি করাই।

তিনি বলেন, আইসিইউতে থাকলেও বিকাল পর্যন্ত মোটামুটি ভালো ছিল। কিন্তু রাত থেকেই তার পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। রাত আড়াইটার দিকে মেয়েটা বলে, তার খুব কষ্ট হচ্ছে। চিকিৎসকেরা পানি দিতে বারণ করেছেন। তাই রিফাহর মা পানি দিয়ে শুধু ঠোঁট ভিজিয়ে দিচ্ছিলেন। মেয়ে তৃপ্তি পাচ্ছিল না। বারবার বলছিল, এভাবে সে পানি খাবে না, ভালোভাবে পানি খেতে চায়। পরে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে তাকে গ্লাসে পানি খাওয়ানো হয়, কিছুটা সে তৃপ্তি পায়। তখন মা–বাবা যাতে তার পাশে থাকে, সে কথা বলতে থাকে। মেয়েটা ভেবেছিল, মা–বাবা চলে গেলেই চিকিৎসকেরা তাকে আর পানি খেতে দেবেন না। অস্থিরতায় বারবার মেয়ে তার মাথায় বাতাস দিতে বলে।

‘ডাক্তার জানিয়েছিলেন তার (রিফাহ) ফুসফুসে পানি জমে গিয়েছিল। এরপর মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আমার মেয়েটা মারা গেল’।

পূর্বেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলো কি-না জানতে চাইলে রিফাহ’র বাবা বলেন, সেপ্টেম্বর মাসের দিকে একবার জ্বর হয়েছিল। তখন আবার ডেঙ্গু টেস্ট করালে রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। প্রথমবারই আমার মেয়েটা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হল। এমনকি শুক্রবার জ্বর শুরু হলেও সেটি ছিল শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত। এরপর তার কোনো জ্বর ছিল না। শুক্রবারের আগেও তার কোনো জ্বর ছিল না। এমন একটা রোগী যে কোনো মুহূর্তেই সহজে ভালো হয়ে যায়, কিন্তু তার ক্ষেত্রে হলো ভিন্নটা। খুব অল্প সময়েই তার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল এবং অল্প সময়েই আমাদেরকে কোনো চিকিৎসার সুযোগ না দিয়েই চলে গেলো।

শিশু রিফাহ প্রসঙ্গে বাবা আরও বলেন, নিজের মেয়ে বলে বলছি না, আমাদের মেয়েটা ছিল একটা পরি, আল্লাহ সেই পরিটাকে নিয়ে গেছেন। মেয়েটা কোনো জিদ বা বায়না করত না। স্কুলে আমার মেয়ের জন্য কাঁদেনি এমন একটা বাচ্চাও পাওয়া যাবে না। সবাই ওকে খুব ভালোবাসত।

তিনি বলেন, আমার দুইটা মেয়ে ছিল, তার মধ্যে সেই ছিল বড়। ছোট মেয়েটার বয়স সাত বছর, ক্লাস ওয়ানে পড়ে ওই স্কুলেই। হঠাৎ করে আমার পরিবারের উপর এত বড় একটা ঝড় বয়ে যাবে আমি কল্পনাও করতে পারিনি। আমার পরিবারের অবস্থা এখন খুবই খারাপ, বিশেষ করে বাবুর মায়ের অবস্থা বেশি খারাপ। পাগল প্রায় অবস্থা তার। আমার মেয়ের জন্য এবং আমাদের জন্য দোয়া করবেন।

শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত (একদিনে) ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরো তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৫১৭ জন। একইসঙ্গে এই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আরো ১৮৬ জন।

বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১৮৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বরিশাল বিভাগে ৪ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৫ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি কর্পোরেশনের বাইরে) ৪০ জন, ঢাকা উত্তর সিটিতে ৪২ জন এবং দক্ষিণ সিটিতে ৬৭ জন, খুলনা বিভাগে ১৭ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ জন, এবং সিলেট বিভাগে ১ জন ভর্তি হয়েছেন।

Main Admin:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings