রৌদ্রস্নাত পড়ন্ত বিকেলের নিস্তব্ধতায় অবশেষে পৌঁছুতে পারলাম। এ যেন অনেক দিনের কাঙ্খিত ক্ষণটি এল। গাড়ি থেকেই দেখা যাচ্ছিল চারিদিকে সবুজের সমারোহ। নীল আকাশের নিচে যেন সবুজ গালিচা পেতে অপেক্ষায় প্রকৃতি। চা বাগান দর্শন এটিই প্রথম নয়। চা বাগান মানেই যে সবুজের চাদর বিছানো উঁচু-নিচু টিলায় দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দৃশ্য তা মনে গেঁথে আছে তখন থেকেই যখন প্রথমবার শ্রীমঙ্গলের চা বাগান প্রদর্শন করেছিলাম বছর কয়েক আগে। এবারের এই চা বাগান দর্শনে ভিন্নতা আছে। উপমহাদেশের সর্বপ্রথম ও প্রাচীন প্রতিষ্ঠিত ও সর্ববৃহৎ চা বাগান মালনীছড়া বলে কথা।সবুজে ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর মালনীছড়া! বাগানটির প্রবেশ পথ দেখতেই ড্রাইভারকে থামাতে বলে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে মিরাক্কেলখ্যাত স্ট্যান্ডআপ কমেডিয়ান আবু হেনা রনি ভাই। মজার মানুষ বটে। এ ছাড়াও বাংলা পুঁথি গবেষক, পুঁথি সংগ্রাহক ও পুঁথি শিল্পী এথেন্স শাওন ভাইয়ের পরম ও সরস সান্নিধ্য ছিল।
চোখ যেনো মাটিতে পড়ে না। রূপসীর অতুলনীয় রূপে ডুবে যেতে লাগলাম। ‘পড়ে না চোখের পলক’ স্টাইলে দেখা যাকে বলে। স্যাট স্যাট ছবি তোলার কাজটি চলছে। সমানে চলছে ভিডিও ধারণও। খাদিমনগর ইউনিয়নে বিমানবন্দর সড়কের পাশে অবস্থিত এই চা বাগান। বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান মালনীছড়া। স্থানীয় ভাষায় বলা হয়- ‘মালনীচেরা চা বাগান’। যেখানে চলছে সবুজের চাষাবাদ। ইংরেজি বানানটাও বোধ করি সেখান থেকে লেখা হয়। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে দূরত্ব মাত্র সাড়ে চার কিলোমিটার। সিলেট শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে লাক্কাতুরা ও মালনীছড়া চা বাগানের দূরত্ব মাত্র তিন কিলোমিটার।
চায়ের দেশ মূলত চীন। প্রাচীন চীনাদের হাত ধরে এগিয়ে যায় চায়ের চাষ। জানা যায়, চীন দেশে ১৬৫০ সালে প্রথম চা উৎপাদন শুরু হয়। চা পান করাকে দেশটির তৎকালীন বুদ্ধিজীবী সমাজ নাকি দৈনন্দিন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের একটি মনে করতেন। চীনাদের প্রায় ২০০ বছর পরে ১৮৫৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশের সিলেটে প্রথম চা উৎপাদন শুরু হয়। প্রচলিত আছে, এ সময় ইংরেজরা চা আসক্ত হয়ে পড়েন। চীনের ছোঁয়ায় ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা চাষ শুরু হয়। ব্রিটিশদের তত্ত্বাবধানে ১৮২৮ সালে চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরসহ চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় চা উৎপাদনের চেষ্টা করা হয়। চায়ের ফলন আশানুরূপ হয় না। ব্রিটিশরা হাল ছাড়েনি। ১৮৪৭ সালে মালনীছড়া চা বাগান করে সফলতা আসে। এখান থেকে ধীরে ধীরে চা’র বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে।
গবেষকরা বলছেন, চট্টগ্রামের কোদালা চা বাগান দেশের প্রথম চা বাগান। যা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৩ সালে। যদিও অন্যান্য গবেষকদের মতে, ১৮৫৪ সালে দেশে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়া চা বাগান মালনীছড়া। মালনীছড়া চা বাগানের মাধ্যমেই দেশে চা চাষের গোড়াপত্তন। যদিও চা বোর্ডের রেকর্ডপত্রে বাগানের প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৫৬ সালের ১৪ আগস্ট।
অন্য গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, মালনীছড়া চা বাগানটি মূলত ১৮৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃটেনের নাগরিক লর্ড হার্ডসন বাগানটি প্রতিষ্ঠা করেন। শহরের যেকোনো জায়গা থেকে রিকশা কিংবা অটোরিকশায় সহজেই মালনিছড়া চা বাগানে যাওয়া যায়। কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ঘুরে আসা যায় যথেচ্ছা।
প্রথম দিকে এই চা বাগান পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহু ইংরেজ। এরপর সময়ের পরিক্রমায় যুক্ত ছিলেন পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি নানান ব্যবস্থাপক। এই চা বাগানের মোট আয়তনের ৭০০ একর জায়গা জুড়ে রাবার ও সাত একর জায়গায় কমলা উৎপাতি হচ্ছে। বাগানে স্থায়ী-অস্থাীয় মিলে প্রায় আড়াই হাজার শ্রমিক কাজ করেন। প্রতিদিনই দল বেঁধে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় জমান এই সবুজের মেলায়।
বিভিন্ন প্রতিবেদন মতে, দেশে উৎপাদিত মোট চা’র ৯০ শতাংশই উৎপন্ন হয় সিলেটে। বাংলাদেশের ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টির অবস্থান বৃহত্তর সিলেটে। এ জন্যেই সিলেটকে ‘দুটি পাতা একটি কুড়ির দেশ’ বলা হয়। বৃহত্তর সিলেটের মধ্যে সিলেট জেলার জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, গোয়াইনঘাট, কোম্পানীগঞ্জ ও সিলেট সদর উপজেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি চা বাগান। যার মধ্যে মালনিছড়া, লাক্কাতুরা, তারাপুর, দলদলি, খাদিম, বড়জান, গুলিন, আলী বাহার, হাবিব নগর, আহমদ টি এস্টেট, খান চা বাগান, লালাখাল টি এস্টেট, শ্রীপুর চা বাগান ও মুলাগুল চা বাগান উল্লেখযোগ্য।
নাটক ও সিনেমার ভাল শুটিং স্পটও এই মালনীছড়া চা-বাগানসহ আশপাশের এসব চা-বাগান। ছুটির দিনগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই হাজারো মানুষের ভিড় হয় চা বাগানে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মালনীছড়া চা বাগানে চা গাছের পাশাপাশি কাঁঠালগাছই রয়েছে এক লাখের বেশি। এর বাইরে দারুচিনি, গোলমরিচ, জলপাই, হরীতকী, আমলকী, অর্জুন, জাম, আম, লটকন ও বেলসহ নানা প্রজাতির গাছ রয়েছে এই চা বাগানে। প্রচলিতভাবে এসব গাছের বিভিন্ন ফল নাকি চা-শ্রমিকরা বিনা পয়সাতেই নিজেদের মতো খেতে পারেন! যদিও এর সত্যতা বলার অধিকার শ্রমিকদের।
এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে সিলেট শহরের খুব কাছেই সবুজ ছড়াচ্ছে চা বাগানটি। মাঝে মাঝে টিলাবেষ্টিত ছোট ছোট জনপদ চোখে পড়বে। পাহাড় ও টিলার পাশ ঘেঁষে নেমে গেছে আঁকাবাঁকা কত মেঠোপথ, তার ইয়ত্তা নেই। বাগানের অভ্যন্তরে কোনো যান্ত্রিক দূষণ বা শহুরে কোলাহল নেই। পিনপতন নিরবতা। চা পাতা তোলার মৌসুম নয় বলে শ্রমিকদের তেমন দেখা যাচ্ছে না। সারা বাগানে মাহসুখে রং-বেরঙের চেনা-অচেনা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। কোথাও ছুটে চলছে রূপালী ঝর্ণাধারা। যতদূর চোখ যায় কেবলই সবুজ। হাঁটছি। চায়ের সবুজ পাতাগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছি। চা বাগানের কোনো এক কোন থেকে ভালোবাসার স্পর্শে হেঁটে আসছেন নবদম্পতি। একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাওয়ার দৃশ্যও চোখ এড়ায় না। মনে হতে পারে তারা চা-বাগানের আশেপাশে কোনো জায়গা থেকে একটু আগেই বিয়ের পিঁড়ি থেকে হানিমুনে চলছেন চা-বাগানের অভ্যন্তরে। তারা এই অনিন্দ্যসুন্দর প্রকৃতিকে স্বাক্ষী রাখতে চায়। পেছনে তাদের ক্যামেরাপার্সনের হাঁক-ডাক, ‘দুজন একটু এভাবে দাঁড়ান’।
উঁচু টিলায় উঠছি। নিচে নেমে যাচ্ছি বাঁকে বাঁকে। কতদূরে এর শেষ? কোনো অন্ত পাচ্ছি না। অগত্যা মামার স্মরণাপন্ন হলাম। গুগল মামা বলছে – প্রায় আড়াই হাজার একর ভূমিস্বত্ব সীমানা নিয়ে উঁচু-নিচু টিলার পর টিলায় ভরা চা-বাগান। সুন্দরীর কোলে উঠে নেমে এলাম। আদি-অন্ত পর্যন্ত পৌঁছানো এবার আর হবে না। সময় কম। সন্ধ্যের ডাক। ফেরার ডাক।
দিগন্তে সূর্য নেমে যাচ্ছে। সূর্য ও আকাশের মিলিত গাঢ় লাল রঙ এখন এসে পড়ছে রূপসীর গায়ে। রাত আর যৌবনের হাতছানি পাচ্ছে মালনীছড়া। সন্ধ্যে নেমে আসায় বুকের মধ্যে ধুকধুকানি শুরু হলো। পর্যটকরা ছাড়ছেন। সন্ধ্যে নামছে আর রূপসীর চেহারা কালো হয়ে উঠছে! কিন্তু না! চারপাশের নিয়ন বাতি আর আকাশের গাঢ় লাল রঙ গায়ে মেখে সে তখন আরেক রূপে ফিরে এল। দারুণ এক স্নিগ্ধতায় ভরে উঠছে চারপাশ। এ এক ভিন্ন মায়াবিনী। লাল-নীল-কালো সন্ধ্যের আলোয় রূপবতী মালনীছড়া। এ যেন তার আরেক আবেদনময়ী রূপের প্রকাশ। চিরযৌবনা। তুমি অপেক্ষায় থাকো।
লেখক: ওয়ালটনের জনসংযোগ বিভাগের সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর
mahfuzsobhan09@gmail.com