X

তরুণদের কেন ধরে রাখতে পারছে না তৈরি পোশাকশিল্প

বাংলাদেশের অর্থনীতি আগাগোড়া বদলে ফেলা জাদুর কাঠির নাম তৈরি পোশাকশিল্প।
গত শতাব্দীর আশির দশকে যাত্রা শুরু করা এই শিল্প ইতিমধ্যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করছে। ফলে কারখানাগুলোতে তৈরি পোশাক উৎপাদনের প্রায় সব প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ও রোবটের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।

দীর্ঘ সময় পোশাকশিল্প এমন কর্মী বাহিনী দিয়ে পরিচালিত হয়েছে, যাঁদের বড় অংশের ছিল না প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, না ছিল প্রযুক্তিবিষয়ক জ্ঞান। তবে দিন বদলেছে। বিশ্বজুড়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে তৈরি পোশাক উৎপাদনে অভূতপূর্ব পরিবর্তন এসেছে। অটোমেশনের কারণে মানুষের সংযোগ কমে আসছে। উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। সেখানে আমরাও যে খুব পিছিয়ে আছি, তা নয়। আমাদের দেশেও আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে, যা একটু আগেই বলেছি।

আশার কথা হচ্ছে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উত্তীর্ণ হওয়া উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা পোশাকশিল্পে কাজ করছেন। তাঁরাই এখন সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের এ খাতকে এগিয়ে নিচ্ছেন। তবে হতাশার কথাও আছে, তরুণদের ধরে রাখার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে পোশাকশিল্প। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে তরুণেরা ঠিকই এ শিল্পে আসছেন। তবে অভিজ্ঞতা অর্জনের পর তাঁদের অনেকে আবার অন্য শিল্পের দিকে ঝুঁকছেন কিংবা বিদেশে চলে যাচ্ছেন। ফলে শিল্পে মেধার বিকাশ হচ্ছে না।

কেন মেধাবী তরুণেরা দীর্ঘ সময় তৈরি পোশাকশিল্পে থাকছেন না, সেটি খুঁজে দেখতে হবে। সেই অনুসন্ধানের কাজটি সরকারের কোনো দপ্তর করতে পারে। সেটি সম্ভব না হলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) ও নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিকেএমইএ) যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে পারে। আমরা এখানে শিল্পের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ এবং তরুণদের নিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণেরা
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকশিল্পের মোট রপ্তানির বড় অংশই ট্রাউজার, টি–শার্ট, সোয়েটার, শার্ট ও অন্তর্বাস। তবে স্যুট, জ্যাকেট, স্পোর্টসওয়্যারের মতো উচ্চমূল্যের পোশাকও বর্তমানে দেশে তৈরি হচ্ছে। আমাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানি বাড়াতে হলে সস্তা পোশাকের পাশাপাশি আরও বেশি উচ্চমূল্যের বা ভ্যালু অ্যাডেড পোশাক উৎপাদনে যেতে হবে। যদিও এসব পণ্য উৎপাদনে আমাদের দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব আছে। সে জন্য উদ্যোক্তারা বেশি অর্থ খরচ করে হলেও বিদেশি বিশেজ্ঞদের আনছেন। শুধু তা–ই নয়, মার্চেন্ডাইজিং, মার্কেটিং, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রকৌশলী পদে কর্মরত আছেন উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বিদেশি কর্মী।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতে কত বিদেশি নাগরিক কাজ করেন, তার কোনো হিসাব নেই। তবে বিজিএমইএর তথ্যানুযায়ী, দেশের তৈরি পোশাক কারখানায় ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া ও পাকিস্তানের নাগরিকেরা কাজ করেন। এ ক্ষেত্রে ওপেন সিক্রেট হচ্ছে, দেশে বৈধভাবে আসা বিদেশি কর্মীদের পাশাপাশি অবৈধভাবেও প্রচুর বিদেশি নাগরিক তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করেন।

একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে, চার দশকের বেশি বয়সী তৈরি পোশাকশিল্পে এখনো কেন বিপুল বিদেশি কর্মীর প্রয়োজন হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ইনস্টিটিউট আছে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর বিপুলসংখ্যক তরুণ বেরও হয়ে আসছেন। তাঁদের বড় একটি অংশ তৈরি পোশাকশিল্পে আসছেন। তাঁরা সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্বও পালন করছেন। তারপরও বিদেশি কর্মীদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমানো যায়নি।

বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। যদিও পোশাক রপ্তানিতে এখনো আমাদের মূল্য সংযোজন কম। তার অন্যতম কারণ—দেশে তুলার উৎপাদন নেই। এখনো বাংলাদেশের কারখানাগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা প্রতিযোগীদের তুলনায় কম। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে কারখানার উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যায়ে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, কার্বন নিঃসরণ কমানো, পণ্য উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায়ের তথ্য সংরক্ষণসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নতুন করে সামনে এসেছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা তরুণদের নিয়ে এগোতে হবে। না হলে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে হবে।

মেধা পাচার রোধ সম্ভব

শুধু তৈরি পোশাক নয়, বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মেধা পাচার রোধ। প্রতিভাবান তরুণেরা আর্থিক নিরাপত্তা ও উন্নত জীবনের আশায় দেশ ত্যাগ করছেন। বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ তরুণ দেশ ছাড়ছেন, তার কয়েকটি তথ্য দেওয়া যাক।
জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২৩ সালে কাজের প্রত্যাশায় গড়ে প্রতি ঘণ্টায় দেড় শ বাংলাদেশি দেশ ছাড়ছেন। প্রতিবছর বাংলাদেশিদের জন্য দেশ-বিদেশে যত নতুন কর্মসংস্থান হয়, তার এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে প্রবাসে।

যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত বিদেশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্রকাশিত ‘ওপেন ডোরস-২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়া বিশ্বের ২৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। এ ছাড়া কানাডা সরকারের ইমিগ্রেশন, রিফিউজিস অ্যান্ড সিটিজেনশিপ (আইআরসিসি) বিভাগের তথ্যানুসারে, দেশটিতে অধ্যয়নে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের আবেদন ২০১৬-১৯ সালের মধ্যে ২৭০ শতাংশ বেড়েছে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় উচ্চশিক্ষাকে উৎসাহিত করা হলেও বিদেশে ডিগ্রিপ্রাপ্ত কাউকে ফিরিয়ে আনার জন্য সে রকম উদ্যোগ বা প্রণোদনা দেখা যায় না। অথচ সঠিক নীতি প্রণয়ন ও প্রণোদনা দিয়ে এই প্রবণতা বিপরীতমুখী করা যেতে পারে। উদ্ভাবনের সংস্কৃতি গড়ে তুলে এবং প্রতিযোগিতামূলক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে এই মেধাবী তরুণদের দেশে রাখা যেতে পারে। তার আগে তরুণ পেশাজীবীদের এ দেশে থাকার জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে জাতীয় অগ্রাধিকার থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন বা তার বেশি করতে হলে তরুণদের শক্তি ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে। দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৮ শতাংশ ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে। এই জনসংখ্যাগত লভ্যাংশ পেতে শিল্পকে অবশ্যই প্রযুক্তি ও টেকসই ব্যবস্থাসহ তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে একসুতায় গাঁথতে হবে।

Main Admin:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings