X

থমকে গেছে ঋণসহায়তা কমিটির কার্যক্রম

দেশের বড় শিল্পগোষ্ঠীগুলোর অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংক গঠিত বিশেষ কমিটির কার্যক্রম কার্যত থমকে গেছে। গত পাঁচ মাসে ১ হাজার ২৫৩টি আবেদন জমা পড়লেও এখনো একটি আবেদনও চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি হয়নি। কমিটির অগ্রগতি এতটাই ধীর যে, এখন পর্যন্ত যাচাইবাছাই সম্পন্ন হয়েছে মাত্র ১০০টি ফাইলের। এ দীর্ঘসূত্রতা শিল্প খাতের জন্য ভয়াবহ সংকট ডেকে আনছে। বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠানে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি হাজারো শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়েছেন। এমন বাস্তবতায় ঋণসহায়তার ধীরগতি এখন জাতীয় অর্থনীতির জন্য বড় হুমকিতে পরিণত হয়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫০ কোটি টাকার বেশি অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি গ্রাহকদের যাচাই করে নীতিসহায়তা দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ কমিটি গঠন করে। উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত সমস্যায় পড়া শিল্পগোষ্ঠীগুলোকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখা, যাতে উৎপাদন অব্যাহত থাকে এবং কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আদায় ঠিক থাকে। কমিটির আহ্বানে মাত্র কয়েক সপ্তাহেই জমা পড়ে ১ হাজার ২৫৩টি আবেদন, যা প্রমাণ করে শিল্প খাতের সংকট কতটা গভীরে। কিন্তু এ আবেদন যাচাইবাছাইয়ের গতিতে হতাশা প্রকাশ করছেন উদ্যোক্তারা। মাত্র ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা, যা স্পষ্টভাবে অর্থনৈতিক অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের শর্তে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ তিন মাসে নামিয়ে আনার কারণে অনেক উদ্যোক্তা অনিচ্ছাকৃতভাবে খেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গঠিত কমিটি গত পাঁচ মাসে মাত্র ১৩টি বৈঠক করেছে। এ সময়ে তারা ১০০টি ফাইল যাচাইবাছাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠিয়েছে চূড়ান্ত পর্যালোচনার জন্য। কিন্তু এখনো কোনো ব্যাংক তা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করতে পারেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক ও কমিটির সদস্য সচিব শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা ১০০টির বেশি কেস বাছাই করে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠিয়েছি। এখন ব্যাংক ও গ্রাহক শর্তপূরণ করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। বাকি কেসগুলো দ্রুত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া চলছে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, অনেক গ্রাহক কমিটির দেওয়া নির্দেশনা অনুযায়ী আবেদন করেননি। কেউ কেউ খেলাপি না হয়েও ঋণ পুনর্গঠনের জন্য আবেদন করেছেন। আবার কিছু গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী প্রমাণাদি জমা দেননি। এতে যাচাইবাছাইয়ে সময় লাগছে। অন্যদিকে, আবেদনকারীরা বলছেন, চরম মন্দা ও আর্থিক সংকটে দ্রুত সিদ্ধান্ত না এলে তাদের পক্ষে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘হাজারের বেশি আবেদন একটি কমিটির পক্ষে যাচাই করা কঠিন। তাই কমিটির সংখ্যা বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে। আমরা চাই প্রকৃত খেলাপিরা যাতে আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘দেড় দশকের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে অনেক ঋণ এতদিন ধামাচাপা দেওয়া হয়েছিল। এখন তা নিরীক্ষায় প্রকাশ পাচ্ছে। তবে যারা ন্যায়সংগত কারণে খেলাপি হয়েছেন, তাদের জন্য নীতিগত সহায়তা দিতে চাই।’

অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা মনে করেন, সময়মতো সিদ্ধান্ত না নিলে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান মুখথুবড়ে পড়বে। এর প্রভাব সরাসরি কর্মসংস্থান, আয়, রপ্তানি ও রাজস্ব আদায়ে পড়বে। তারা বলেন, একদিকে আইএমএফের চাপ, অন্যদিকে দেশীয় বাজারের অনিশ্চয়তার মাঝখানে বিপর্যস্ত উদ্যোক্তাদের জন্য দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত ছাড়া বিকল্প নেই।

জাতীয় অর্থনীতির জন্য অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সহায়তা এখন সময়ের দাবি। বাংলাদেশের শিল্প খাতের টেকসই বিকাশে এ ধীরগতি দ্রুত নিরসন করতে না পারলে তা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বাংলাদেশ ব্যাংক যদি সত্যিই সংকট নিরসনে আন্তরিক হয়, তাহলে শুধু পর্যালোচনায় নয়; দ্রুত, স্বচ্ছ ও বাস্তবভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান মতে, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের   মার্চ শেষে খেলাপির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ।

বড় ঋণ পুনর্গঠন কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক : বড় ঋণগ্রহীতাদের অনিচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণ পুনর্গঠন ও নীতিসহায়তা দেওয়ার লক্ষ্যে গঠিত বাংলাদেশ ব্যাংকের পাঁচ সদস্যের বিশেষ কমিটি নেতৃত্ব সংকটে পড়েছে। কমিটির প্রথম আহ্বায়ক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের অফসাইট সুপারভিশন বিভাগের তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক। তিনি এখন রাজশাহী অফিসে বদলি হয়েছেন। তাঁর স্থলে এখন দায়িত্ব পালন করছেন নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম। কিন্তু সাবেক আহ্বায়ক মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি মামলার আলামত নষ্ট করার গুরুতর অভিযোগ। সিআইডির তদন্তে তাঁর বিরুদ্ধে দায় চিহ্নিত হয়েছে, যা প্রশ্ন তুলেছে গুরুত্বপূর্ণ একটি নীতিসহায়তা কমিটির নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়েই। বর্তমানে কমিটির সদস্যরা হলেন- আহ্বায়ক বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম; সদস্য হিসেবে রয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের যুগ্ম সচিব ড. দেলোয়ার হোসেন, অর্থনীতিবিদ মামুন রশিদ; ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হক বে কোম্পানির আবদুল হক এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি বিভাগের পরিচালক শাহরিয়ার সিদ্দিকী রয়েছেন সদস্য সচিব হিসেবে। কমিটির মেয়াদ নির্ধারিত না হলেও প্রতি মাসে সর্বোচ্চ দুটি সভায় অংশ নিয়ে ভাতা গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক মেজবাউল হক গুরুত্বপূর্ণ আলামত নষ্ট করেন। তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি দুই বিদেশি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানকে চুরির ঘটনাস্থলে নিয়ে যান এবং বেআইনিভাবে তাদের দিয়ে ‘ক্রাইম সিন’ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করান। এতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও ডিজিটাল আলামত বিনষ্ট হয়ে যায়। এ ঘটনার ৩৯ দিন পর, ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় মামলা দায়ের করা হয়। সে মামলা এখন সিআইডির তদন্তাধীন। সিআইডির প্রতিবেদনে তৎকালীন গভর্নরসহ অন্তত ১২ জন কর্মকর্তার দায়িত্বে গাফিলতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন মেজবাউল হক। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার চুরি হয়।

সাবেক আহ্বায়ক মেজবাউল হকের বিরুদ্ধে শুধু রিজার্ভ চুরির আলামত নষ্ট নয়, বরং আরও একাধিক অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’-এর অনুমোদন প্রদান নিয়ে অনিয়ম; ‘বিনিময়’ অ্যাপ চালু করে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের আস্থা অর্জনের চেষ্টা; ২০২৪ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত এবং বিভিন্ন পদে থেকে স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। এসব অভিযোগ মিলে তাঁর নেতৃত্বাধীন কমিটি আদৌ স্বচ্ছভাবে কাজ করেছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঋণসহায়তা কমিটির মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে এমন বিতর্কিত ব্যক্তিকে দায়িত্ব দেওয়া অনভিপ্রেত ছিল। এতে প্রকৃত অনিচ্ছাকৃত খেলাপিরা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, আর প্রভাবশালীরা সুযোগ নিতে পারেন। এ ধরনের কমিটিতে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তির পেশাগত সততা, নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা থাকা জরুরি। একই সঙ্গে তারা পরামর্শ দিয়েছেন, একদিকে যেন প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত উদ্যোক্তারা সহায়তা পান, অন্যদিকে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া অব্যাহত রাখা হয়।

Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings