X

নানামুখী চাপে দেশের অর্থনীতি

বিনিয়োগ স্থবির, বেকারত্ব বৃদ্ধি, প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বৈদেশিক বাণিজ্যে টানাপোড়েন, খেলাপি ঋণে ঊর্ধ্বগতিসহ নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অর্থনীতিকে এই অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এটা মোকাবিলায় সমন্বিত নীতি গ্রহণ ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।

তারা বলছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক দিক থেকে নানামুখী চাপের মধ্য দিয়ে গেলেও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, আন্তর্জাতিক সহায়তা এবং কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে পুনরুদ্ধারের সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য সুশাসন, বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি ও সামাজিক নিরাপত্তা জাল সম্প্রসারণ করতে হবে।
এই সরকারের এটা প্রথম বাজেট এবং হয়তো শেষ বাজেটও। আর তো তাদের থাকার কথা নয়।
তারা আরও বলছেন, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ব্যাংকখাত ঠিক করতে হবে, বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে হবে, বন্দর আধুনিকায়ন করতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে, প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ করতে হবে। কিন্তু এগুলো ঘটবে কি না, সেটা বলা এখন মুশকিল। এসব কিছুর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশে বেসরকারি বিনিয়োগে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিনিয়োগ যে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ দেখলেই অনুমান করা যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়ায় মাত্র ৬ দশমিক ৮২ শতাংশ, যা ১০ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিনিয়োগে মন্দা থাকায় বাড়ছে বেকারত্ব।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সাল শেষে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখ। একবছর আগে অর্থাৎ, ২০২৩ সালে ছিল সাড়ে ২৫ লাখ। এ হিসাবে এক বছরে বেকারের সংখ্যা বেড়েছে দেড় লাখ।

বিনিয়োগ খরার মধ্যে বিভিন্ন দাতা সংস্থা চলতি অর্থবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের ঘরে থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক বলছে- প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ হতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে ৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বলছে- প্রবৃদ্ধি ৩ দশমিক ৯০ শতাংশ হতে পারে। দাতা সংস্থাগুলো প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিয়েছে বাস্তবে তাই হতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীবিদরাও।
অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার পূর্বশর্ত হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। সেটার তো কোনো আশা-ভরসার জায়গা এখন দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের অবস্থা থেকে এগুলো মোকাবিলা করা খুব কঠিন। অর্থনৈতিক অবস্থা যাতে আরও খারাপ না হয় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।-অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন

অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, ‘অর্থনীতির সমগ্র মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে স্থিতিশীলতা অর্জনের ওপরে। এটা কিন্তু একপেশে হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, দারিদ্র্য হ্রাস, বেকারত্ব হ্রাস এগুলো যথাযথ মাত্রায় মনোযোগ পাচ্ছে না। এটার জন্য যেটা হবে অনিবার্যভাবে দারিদ্র্য বাড়বে, বেকারত্ব বাড়বে, প্রবৃদ্ধি কমবে। সুতরাং, দাতা সংস্থাগুলো প্রবৃদ্ধি নিয়ে যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি।’
বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে রয়েছে অর্থনীতি। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমেছে, তারপরও এখনো ৯ শতাংশের ওপরে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নিম্ন আয়ের মানুষ বেশ চাপে রয়েছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের এপ্রিল শেষে সার্বিক মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। এক মাস আগে অর্থাৎ, মার্চে ছিল ৯ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০২৪ সালের নভেম্বরে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এরপর চলতি বছরের জানুয়ারিতে মূল্যস্ফীতির হার কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ হয়। ফেব্রুয়ারিতে তা আরও কমে হয় ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ।
অর্থনীতির নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে নতুন সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ভারতের বিধিনিষেধ। ভারত বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর যে বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, তার ফলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রভাব পড়ছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি প্রতিযোগিতায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের চাপ।
এদিকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। তিন মাস আগে অর্থাৎ, ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। এ হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ ছিল ১ লাখ ৪৫ হাজার ৬৩৩ কোটি টাকা।

সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য ব্যাংকখাত ঠিক করতে হবে। গ্যাসের সমস্যার সমাধান করতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে হবে। বন্দর আধুনিকায়ন করতে হবে। শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। রপ্তানি বৈচিত্র্য আনতে হবে। কিন্তু এগুলো ঘটবে কি না বা কীভাবে ঘটবে সেটা বলা এখন মুশকিল হয়ে গেছে।’

এতকিছুর মধ্যে দুটি সূচক রয়েছে ইতিবাচক। রেমিট্যান্সপ্রবাহ অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো। রেকর্ডও গড়েছে কয়েক মাস আগে। রিজার্ভও আগের চেয়ে ভালো। রপ্তানিও রয়েছে ইতিবাচক ধারায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ৩৭ লাখ ৭০ হাজার ডলারের রেমিট্যান্স আসে। এরপর আগস্টে ২২২ কোটি ১৩ লাখ ২০ হাজার ডলার, সেপ্টেম্বরে ২৪০ কোটি ৪১ লাখ ডলার, অক্টোবরে ২৩৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার, নভেম্বরে ২২০ কোটি ডলার, ডিসেম্বরে ২৬৪ কোটি ডলার, জানুয়ারিতে ২১৯ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে ২৫৩ কোটি ডলার, মার্চে ৩২৯ কোটি ডলার এবং সবশেষ এপ্রিলে রেমিট্যান্স আসে ২৭৫ কোটি ডলারের।
আর রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় এক শতাংশেরও কম হারে বেড়ে ৩ দশমিক ০১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। আগের বছরের একই সময়ে এই আয় ছিল ২.৯৯ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে রপ্তানি আয় ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ বেড়ে ৪০ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৩৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার।
অর্থনীতিবিদ ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘এমন তো না যে আমাদের শিল্প-কারখানা নষ্ট হয়ে গেছে বা বন্যায় আমাদের তীব্র ক্ষতি হয়েছে। এমন কিছু তো নয়। এটা জাস্ট সাময়িক কিছু সমস্যা তৈরি হয়েছে। রেমিট্যান্স আসছে, রপ্তানির প্রবৃদ্ধিও একেবারে খারাপ নয়। সে জন্য আশা করা যায়, আগামীতে এগুলো ঠিক হয়ে যাবে।’
বিনিয়োগে স্থবিরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দেশের অর্থনীতি কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন? এমন প্রশ্নে অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ বলেন, শোনা যাচ্ছে সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে, আমি জানি না সত্যিই মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হবে কি না। সরকার যদি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতা দেয়, তাহলে একাংশকে সরকার মুদ্রাস্ফীতি থেকে প্রোটেকশন দিলো, অন্য অংশকে কিন্তু দিলো না। এখন মুদ্রাস্ফীতি যদি কমে যায়, তাহলে এই মহার্ঘ ভাতা একদিকে ওদের আয় বাড়াবে, কিন্তু নন-ফর্মাল সেক্টরে যারা আছেন তাদের আয় বাড়াবে না। ৮৯ শতাংশ শ্রমিক তো নন-ফর্মাল সেক্টরে আছেন। সুতরাং, এটা বৈষম্য বাড়াবে। তাহলে তো সরকারের বৈষম্যবিরোধী নীতির সঙ্গে মিলছে না।’

firoz:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings