নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। দেশে অনেক দিন ধরেই বিভিন্ন মহল থেকে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানানো হয়েছিল। গত বৃহস্পতিবার ইসি সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ জানান, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত রোডম্যাপ অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন হবে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে এবং তফসিল ঘোষণা হবে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে। ইসির রোডম্যাপ অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে অংশীজনের সঙ্গে সংলাপ করবে ইসি। নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সুশীল সমাজ, নারী প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যমকর্মীরা এই সংলাপে অংশ নেবেন। ইসির নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। এই রোডম্যাপ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নির্বাচনের পথে আরেক ধাপ এগিয়ে গেল। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা জানিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে। কিন্তু তারপরও নির্বাচন নিয়ে জনমনে সংশয়-সন্দেহ কাটছে না। বিভিন্ন মহলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলেও জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল নেতিবাচক বক্তব্য দিয়েছে। ফলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি কিছু জায়গায় ‘মব সন্ত্রাস’ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি এবং একের পর এক দাবি উত্থাপিত হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে নির্বাচন কীভাবে হবে? তারা বলছেন অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পার হয়েছে; তবু এখন পর্যন্ত দেশে স্থিতিশীলতা আসেনি।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, নির্বাচনের আগে রাষ্ট্র সংস্কার, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন, সংবিধান পরিবর্তন এবং পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনসহ একের পর এক ইস্যু পরিকল্পিতভাবে তৈরি করছে একটি পক্ষ। নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এসব ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে। কারণ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই এক ধরনের চাপ অনুভব করছে জামায়াত ও এনসিপি। সভা-সমাবেশ আর ভোটের রাজনীতি এক নয়। ভোটে এককভাবে জিতে আসাও তাদের জন্য কঠিন। তারা বিভিন্ন দাবি তুলে আসন নিয়ে দর-কষাকষি বা সমঝোতার চিন্তা থেকেও বিএনপির ওপর চাপ তৈরির কৌশল নিতে পারে বলে মনে করছে দলটির হাইকমান্ড। এদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বাইরে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে বিরোধ অবসানের জন্য ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। পর্দার আড়ালে একটি মহল এই দুই দলের মধ্যে মতবিরোধ কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় পিআর পদ্ধতি, সংস্কার, বিচার এবং জুলাই সনদ নিয়ে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির প্রকাশ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে।
এ কারণে অনেকে যথাসময়ে নির্বাচন হওয়ার প্রশ্নে সংশয় প্রকাশ করছেন। সংশয় সন্দেহের মূল যেখানে নির্বাচনের আগে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার, জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি ও কার্যকর, জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার গণহত্যার বিচার এবং নতুন সংবিধানের জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের দাবিতে রাজপথে রয়েছে এনসিপি। এ ছাড়া বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে মত-দ্বিমত ক্রমেই বাড়ছে। এই মত-দ্বিমত গিয়ে পৌঁছায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে। এই প্রশ্নে ঐকমত্য কমিশনও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছে। সেখানে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে করা যায় কি না, সেই প্রস্তাব এসেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন ২৩ আগস্ট বলেছেন, আনুপাতিক পদ্ধতি বা পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন সংবিধানে নেই। সংবিধানের বাইরে আমরা যেতে পারি না। ফলে আগামী দিনে কী হয়, সেটা এখন দেখার বিষয়।
অতীতে অনুষ্ঠিত সব ভোটের চেয়ে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হবে বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশন। বিগত তিনটি নির্বাচনে জনগণের রায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। এ অবস্থায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন করা কমিশনের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী খবরের কাগজকে বলেন, জনগণ পরিবর্তন চেয়েছিল, সেই পরিবর্তন না হলে আমজনতা ক্ষুব্ধ হবে, এটাই স্বাভাবিক। সংকট থেকে বের হয়ে আসতে অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যমান উদ্যোগ নিলে অনিশ্চয়তা কেটে যাবে।
নির্বাচনের স্বাভাবিক পরিবেশ বজায় রাখতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন এবং মব প্রতিহত করতে দৃশ্যমান কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা থাকবেই তারপরও সংশয় কাটিয়ে নির্বাচনের জন্য যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকার নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, এটা নির্বাচনি পরিবেশের জন্য ইতিবাচক দিক। এখন নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক দলগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সরকারের পাশাপাশি সব রাজনৈতিক দলকে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে।