X

ফসল বাঁচাতে কৃষকের মৃত্যুফাঁদ, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ও প্রাণী

সপ্তাহ খানেক আগের কথা। দিনটি ছিল শুক্রবার। ওই দিন বিকেলে নিজের ধান খেতের আইলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে টানটান করে গুনা তার (লোহার তার) বাঁধছিলেন কৃষক প্রিয়জিত মণ্ডল। এই তারে পরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হবে। তখন এটি একটি ফাঁদে পরিণত হবে। মূলত ইঁদুর মারার জন্য ফাঁদটি তৈরি করা হচ্ছে। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ধানখালী এলাকার এই কৃষক জানেন, এভাবে বিদ্যুৎ ফাঁদ তৈরি করা যায় না। কাজটি অবৈধ। কিন্তু ইঁদুর মারতে বিকল্প সব পদ্ধতি অনুসরণ করেও দিন শেষে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এলাকার অন্য কৃষকদের মতো তিনিও শেষ পর্যন্ত ইঁদুর মারার বৈদ্যুতিক ফাঁদ তৈরি করেছেন।
শুধু ইঁদুর মারার জন্য নয়, বৈদ্যুতিক এমন ফাঁদ ওই এলাকার অন্যান্য ফসল ও সম্পদ রক্ষার কাজেও ব্যবহার করা হচ্ছে। শিয়ালের হাত থেকে পোলট্রি ফার্মের মুরগি রক্ষা, ঘেরের মাছ চুরি ঠেকানো, ঘেরের আইলের ফসল রক্ষাসহ নানা কাজে অবৈধ ফাঁদটি ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে ইঁদুরভোজী প্রাণী যেমন পেঁচা, শিয়াল, বেজি, সাপ, গুইসাপসহ বিভিন্ন প্রাণী মারা যাচ্ছে। এমনকি এই ফাঁদে পড়ে মানুষও মারা গেছে। তারপরও এগুলো বন্ধে সরকারি-বেসরকারি সংস্থার পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

উপজেলার একাধিক কৃষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর আগাম বৃষ্টি হওয়ায় ধানের খেতগুলো সবুজে ছেয়ে গেছে। এতে কৃষক ভালো ফলনের স্বপ্ন বুনছেন। কিন্তু হঠাৎ ইঁদুরের উপদ্রবে তারা হতাশ হয়ে পড়েছেন। দলবেঁধে ইঁদুর আক্রমণ করে ধানগাছগুলো কেটে সাবাড় করছে। ফলে কৃষকরা পড়েছেন বিপাকে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও ইঁদুর মারতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত বৈদ্যুতিক ফাঁদের ওপর ভরসা করছেন।
অবৈধ হওয়ার পরও কেন এই ফাঁদ তৈরি করছেন জানতে চাইলে কৃষক প্রিয়জিত মণ্ডল বলেন, ‘বিষটোপ, ইঁদুর নিধন ট্যাবলেট, পলিথিনের নিশানা আর কলাগাছ পুঁতেও কোনো কাজ হয়নি। কূলকিনারা না পেয়ে এখন ফাঁদ পাতছি।’ ধানের আবাদ করতে তার প্রতিবিঘায় ৬ হাজার টাকা খরচ হয়েছে জানিয়ে বলেন, ‘একদিকে পানির সংকট, অন্যদিকে সার-কীটনাশকের দাম বেশি। এর ওপর আবার ইঁদুরের উৎপাত। তাই বাধ্য হয়ে অবৈধ জেনেও কাজটি করেছি।’

স্থানীয়রা জানান, ফাঁদটি মাটির খুব কাছাকাছি দেওয়া হয়, যেন কোনো ইঁদুর খেতে ঢুকতে গেলে মারা যায়। আরেকটি তার ঝোলানো হয় কিছুটা ওপরে। সাধারণত বৈদ্যুতিক ফাঁদে কাউকে পাহারায় রাখতে হয়। কিংবা এমন কোনো চিহ্ন দিতে হয়, যা দেখে মানুষ বুঝতে পারে। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে পাহারা বা চিহ্ন কোনো কিছুই থাকছে না। এতে দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। গতবছর উপজেলার মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের উত্তর কদমতলায় শোকর আলী গাজী নামে এক কৃষক ইঁদুর মারার ফাঁদে প্রাণ হারিয়েছিলেন। এ ছাড়া আরও একাধিক মৃত্যুর খবর এলাকায় আলোচিত আছে।

ইঁদুরের উপদ্রব এড়াতে ফসলের মাঠে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দেওয়া কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয় জানিয়ে শ্যামনগর সরকারি মহসিন ডিগ্রি কলেজের কৃষি বিভাগের প্রধান প্রফেসর ড. শেখ আফসার উদ্দিন বলেন, ‘ইঁদুরের ফাঁদ নিমিষেই মানুষের ফাঁদে পরিণত হতে পারে। তাই ইঁদুরের উপদ্রব এড়াতে বিকল্প উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া ফসলের মাঠে বৈদ্যুতিক ফাঁদ দেওয়ার ব্যাপারে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে হবে।’

বৈদ্যুতিক ফাঁদকে অবৈধ উল্লেখ করে শ্যামনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হুদা বলেন, ‘কৃষকের এই ফাঁদ ব্যবহারের অনুমতি নেই। এরপরও নির্দেশনা উপেক্ষা করে অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ এই ফাঁদটি তৈরি করছেন। এটা বন্ধ করা যাচ্ছে না। গত বছরের তুলনায় এবার অনেক বেশি জমি বোরো-ইরি চাষাবাদের আওতায় এসেছে। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে এসব খেত পরিদর্শন করে ইঁদুর নিধনের বিষয়ে কৌশল জানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’

ঝুঁকিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগের ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার সঞ্জিত কুমার মণ্ডল বলেন, ‘গুনা তার ঝুলিয়ে তাতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া রীতিমতো আইনের লঙ্ঘন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও উপজেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা আছে।’ এসব কাজ থেকে বিরত থাকতে মাইকিং করবেন বলে জানেন তিনি।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোছা. রনী খাতুন বলেন, ‘বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এ ধরনের মরণ ফাঁদ তৈরি খুবই বিপজ্জনক। ইঁদুর নিধনের জন্য আরও কার্যকরী ও নিরাপদ পদ্ধতি উদ্ভাবন করা ও কৃষকদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য কৃষি বিভাগকে অনুরোধ করা হয়েছে।’

 

Main Admin:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings