তিনজন জ্যেষ্ঠ এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের নতুন পরিচালক হিসেবে যাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তার নাম প্রাথমিক তালিকাতেই ছিল না। তুলনামূলক কনিষ্ঠ এই কর্মকর্তার নির্মাণকাজের অভিজ্ঞতা নেই বললেই চলে। এই নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ উঠেছে।
প্রকল্প পরিচালকের পর স্পর্শকাতর এই প্রকল্পে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ হলো চিফ সুপারিনটেনডেন্ট। ওই পদেও একজন দক্ষ প্রকৌশলীকে সরিয়ে এমন একজনকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যাকে ওই কাজ করতে অন্তত ১২ মাস প্রশিক্ষণ নিতে হবে। তাছাড়া তার চাকরির নিয়োগের বৈধতা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন।
এমন পরিস্থিতিতে দফায় দফায় পিছিয়ে যাওয়া দেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট থেকে চলতি বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হলেও এমন জগাখিচুড়ি অবস্থার কারণে এটি আরও বছরখানেক দেরি হতে পারে। সেই সঙ্গে নির্মাণকাজ এবং এর নিরাপত্তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। উদ্বিগ্ন খোদ রাশিয়ানরাও।
ইতিমধ্যে পরমাণু শক্তি কমিশনে চিঠি দিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত পারমাণবিক শক্তি সংস্থা রসাটম। রূপপুর প্রকল্পের এসব জটিলতা নিয়ে রসাটমের প্রতিনিধিরা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাতেরও চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে রাশিয়ার একটি সূত্র দেশ রূপান্তরকে জানিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দেশের জন্য খুবই জরুরি, গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর প্রকল্প। এটি বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মর্যাদাও বাড়িয়েছে। এমন একটি প্রকল্পে অবশ্যই দক্ষ জনবল নিয়োগ দেওয়া উচিত। না হলে নানা রকম আশঙ্কা থেকে যায়। এ ধরনের প্রকল্প নিয়ে হেলাফেলার কোনো সুযোগ নেই। এই অবস্থা চলতে থাকলে স্পর্শকাতর এই প্রকল্পের নির্মাণকাজের পাশাপাশি ভবিষ্যতেও ঝুঁকি তৈরি করবে।
প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে ড. মো জাহেদুল হাছানের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ওই পদে নিয়োগের জন্য তিন কর্মকর্তার জীবন বৃত্তান্ত চেয়ে গত ৭ মে পরমাণু শক্তি কমিশনকে চিঠি দেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।
ওই তিন কর্মকর্তা হলেন- পরমাণু শক্তি কমিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. হাসিনুর রহমান, প্রধান প্রকৌশলী মো. আশরাফুল ইসলাম এবং প্রধান প্রকৌশলী ড. মো. খালেকুজ্জামান। এরা তিনজনই রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের উপ-পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
ওই চিঠি পাওয়ার পর কমিশন থেকে তিনজনের সঙ্গে ড. মো. কবীর হোসেনের নাম যুক্ত করে চারজনের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠায় কমিশন। কবীর হোসেন কমিশনের মানব সম্পদ বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। শেষ পর্যন্ত গত ২৫ মে কবীর হোসেনকেই প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওই ৪ জনের মধ্যে মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তিনজনেরই প্রকল্পের নির্মাণকাজে অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাদের চেয়ে সবচেয়ে কনিষ্ঠ কর্মকর্তা কবীর হোসেনের এই প্রকল্পে সরাসরি নির্মাণকাজের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। মূলত তিনি মানবসম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দায়িত্বের পাশাপাশি দেশে-বিদেশে কর্মীদের প্রশিক্ষণে পাঠানোর কাজ করতেন।
কিন্তু গত বছরের আগস্টে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে সদ্য সাবেক প্রকল্প পরিচালক জাহেদুল হাছানকে চারটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের পাশাপাশি ওই দায়িত্বও দেওয়া হয়। এরপর থেকে কবীর হোসেন পরমাণু শক্তি কমিশনে কর্মরত আছেন।
মূলত নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নানা অনিয়মের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কবীর হোসেনকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় বলে গুঞ্জন রয়েছে।
তার আমলে নিয়োগের শর্ত পূরণ না করেই একাধিক ব্যক্তিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে নিয়োগ দেওয়ার তথ্যপ্রমাণ দেশ রূপান্তরের হাতে এসেছে। এছাড়া কনিষ্ঠদের প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে পরে জ্যেষ্ঠদের ওপরে পদোন্নতি দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে।
চিফ সুপারিনটেনডেন্ট পদে অদক্ষ ব্যক্তি
প্রকল্পের চিফ সুপারিনটেনডেন্ট পদে দায়িত্বে ছিলেন মো. হাসমত আলী। কোনো কারণ ছাড়াই গত ৮ মে ১৮ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়, যাদের মধ্যে হাসমত আলী একজন। চাকরিচ্যুতদের অব্যাহতিপত্রে কারণ উল্লেখ করা হয়েছে- ‘এনপিসিবিএল (নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড)-এ আপনার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই।’
ভুক্তভোগীরা বলছেন, চাকরিতে ন্যায্য অধিকার নিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দাবি জানানো এবং কর্তৃপক্ষের নানা স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলায় কোনো ধরনের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে অন্যায়ভাবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
যে ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে তাদের দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ জনপ্রতি ৭০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা হিসেবে মোট ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৬ কোটি টাকা। একেক জনের একেক বিষয়ে দক্ষ হতে মাসের পর মাস প্রশিক্ষণ নিতে হয়েছে। এদের বড় অংশই কর্মকর্তা এবং ওই পদে কাউকে পদায়ন করতে হলে তাকেও আবার নতুন করে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সে জন্য জনপ্রতি আবার ওই পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে প্রকল্পের। বিষয়টি নিয়ে এরই মধ্যে সংকট তৈরি হয়েছে।
হাসমত আলীর পরিবর্তে ভারপ্রাপ্ত চিফ সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রকল্পের ডেপুটি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট মুশফিকা আহমেদ। তবে ওই পদে দায়িত্ব পালনের মতো অভিজ্ঞতা তার নেই।
বিষয়টি নিয়ে গত ২৭ মে পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠিয়েছে রসাটম। প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশ প্রকল্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট এ. ভি ডেইরি স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মুশফিকাকে ওই পদে দায়িত্ব পালনের জন্য তাত্ত্বিক, ব্যবহারিক এবং অন্যান্য বিষয় মিলে অবশ্যই ১২ মাসের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। এরপরই তিনি চিফ সুপারিনটেনডেন্ট হিসেবে যথাযথ দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
মুশফিকা আহমেদ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এনপিসিবিএল-এ ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগদান করেন। তার ওই পদে নিয়োগের শর্তে শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি ন্যূনতম ৯ বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রে অথবা একই ধরনের ক্ষেত্রে পরমাণু বিষয়ক কাজের অভিজ্ঞতা থাকার কথা উল্লেখ ছিল। এছাড়া এই ৯ বছরের মধ্যে রেডিয়েশন মনিটরিং অথবা রেডিওঅ্যাক্টিভ হ্যান্ডলিংয়ে ন্যূনতম ২ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
তবে মুশফিকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ডেল্টা হসপিটাল লিমিটেডে চাকরির অভিজ্ঞতা দেখিয়ে রূপপুর প্রকল্পে চাকরিতে যোগদান করেছেন।
কর্মী অসন্তোষ
বিশ্বের কোথাও পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে আন্দোলনের নজির না থাকলেও দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প সেই ইতিহাস ভেঙেছে। কর্মীরা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ে আন্দোলন করছেন। আর প্রকল্প কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে উঠেছে নানা স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ।
পাবনার রূপপুরে নির্মাণাধীন এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিচালনার জন্য ২০১৫ সালে সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি এনপিসিবিএলের যাত্রা শুরু হয়। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ১ দশকেও প্রতিষ্ঠানটি তার কর্মীদের জন্য ‘সার্ভিস রুল’ চালু করতে পারেনি। সার্ভিস রুল চালুর পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ভাতা, পদোন্নতি, গ্রেড বৈষম্য, পরিবহন সুবিধা, মেডিকেল ভাতা, উপযুক্ত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করাসহ নানান দাবি জানিয়ে আসছিলেন কর্মীরা।
এর জের ধরে বিভিন্ন সময়ে অন্তত ৩শ জনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ এবং ২৬ জনের প্রকল্প এলাকায় প্রবেশের অধিকার কেড়ে নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নিউক্লিয়ার পাওয়ার কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (এনপিসিবিএল)। কর্মীদের দাবির মুখে গত ৬ মে সার্ভিস রুল পাস করার দুই দিন পর ১৮ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। পরে আরও অন্তত ৮ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে সেখানকার কর্মীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কর্তৃপক্ষ এসব দাবি আমলে না দিয়ে উল্টো কর্মীদের হয়রানি এবং তাদের বিরুদ্ধে নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
কোনো ধরনের কারণ দর্শানো ছাড়াই ১৫ প্রকৌশলীকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে পেশাজীবী প্রকৌশলীদের একমাত্র জাতীয় প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি)। প্রকল্পের অনিয়ম-দুর্নীতি ঢাকতে অসৎ উদ্দেশ্যে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে মনে করছে প্রতিষ্ঠানটি।
কেন্দ্রটি চালুর আগেই কর্মীদের এমন অসন্তোষ, বিশৃঙ্খলা আর কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে সেখানে কর্মরত রাশিয়া, আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা-আইএইএ-সহ বিভিন্ন বিদেশির মধ্যে এক ধরনের উদ্বেগ, অস্বস্তি কাজ করছে। এতে দেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তারা কোনো বক্তব্য দেয়নি এ বিষয়ে।
তবে রাশিয়ার একটি সূত্র জানায়, প্রকল্পের সার্বিক বিষয় নিয়ে রসাটমের একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অধ্যাপক ইউনূসের জাপান সফর শেষে এই সাক্ষাৎ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, একটা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য যে ধরনের স্বচ্ছতার দরকার তা রূপপুরে নেই। কারণ শুরু থেকেই বিশেষজ্ঞ ও স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে এই প্রকল্পের কিছুই করা হয়নি। ফলে সেখানে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে। তৈরি হয়েছে বৈষম্য। কর্মীদের অনেক সুযোগ-সুবিধার ঘাটতি রয়েছে। আবার অনেকের দক্ষতারও ঘাটতি রয়েছে। এখানে একনায়কতন্ত্র আর স্বজনপ্রীতি আছে। যার পরিণতি আজকের এই পরিস্থিতি।
এসব বিষয়ে জানতে গত বৃহস্পতিবার পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান (চলতি দায়িত্ব) ড. মো. কামরুল হুদার দপ্তরে গিয়ে এবং এর আগে-পরে একাধিকবার তার মোবাইলে কল করে, খুদেবার্তা পাঠিয়েও বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।