X

বাংলাদেশের বিপদ বহুমুখী

গাজা ইস্যুতে প্রায় দুই বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে জটিল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এর মধ্যে ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ ওই জটিল পরিস্থিতিকে আরো জটিলতর করে তুলেছে। এই যুদ্ধের বহুমাত্রিক নেতিবাচক প্রভাব শুধু আঞ্চলিক নয়, বিশ্বজুড়ে পড়বে। বাংলাদেশের বিপদও বহুমুখী।

এমন প্রেক্ষাপটে সঙ্গে কথা বলেছেন অভিজ্ঞ কূটনীতিক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাঈদ জুবেরী

প্রশ্ন : ইরান-ইসরায়েল সংঘাত কোন দিকে অগ্রসর হচ্ছে বলে আপনি মনে করছেন?

উত্তর : এটি কোন দিকে যাচ্ছে বলা খুব মুশকিল। কিন্তু একটা অনিশ্চয়তার দিকে যে যাচ্ছে তা বলা যায়। এই সংঘাতে তিনটি উপাদান দেখতে পাচ্ছি।

প্রথমটি হলো—ইসরায়েল যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে এই আক্রমণটি শুরু করেছিল সেটি হলো ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ধ্বংস করা। দ্বিতীয়টি হলো—ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল ক্যাপাসিটি ধ্বংস করা। তৃতীয়টি এখন বলা শুরু করেছে। প্রকাশ্যেই তারা ইরানের রেজিম পরিবর্তনের কথা বলছে।

এই তিনটি হলো তাদের প্রধান লক্ষ্যমাত্রা। তবে এখনো কোনো লক্ষ্যমাত্রা তারা অর্জন করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। কারণ ইরান এখনো ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে ইসরায়েলের লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। সেটা তারা নিজেরাও বলছে, লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মার্কিন সাহায্য চাইছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও তাতে মোটামুটি রাজি।

গত দুই দিনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যে এ রকম একটি ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি এই যুদ্ধে কোনোভাবে অংশগ্রহণ করে তাহলে কিন্তু এটি বড় ধরনের সংঘাতে রূপ নিতে পারে। কারণ তখন ওই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট যা আছে সেগুলোও ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার মার্কিন সেনা রয়েছে, তাদের স্থাপনাও আছে। ইরানও সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক অধিকার পাবে। সে রকম যদি হয় তাহলে এই সংঘাতের চেহারা কোন দিকে যাবে তা বলা মুশকিল।

প্রশ্ন : চীন-রাশিয়া এখনো কৌশলগত অবস্থানে আছে। বিবৃতি দিচ্ছে বা নিন্দা জানাচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধে যদি সরাসরি আমেরিকা জড়িয়ে যায়, তখন চীন কিংবা রাশিয়ার ভূমিকা কী হবে বলে মনে করেন?

উত্তর : চীন, রাশিয়া তখনো বেশ চড়া গলায় কথা বলবে, এটা আমার ধারণা। কিন্তু বাস্তবিক অর্থে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই মুহূর্তে তারা সংঘাতে জড়াতে চাইবে বলে মনে হয় না। কারণ গত পাঁচ-ছয় দিন যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তাতে চীন বা রাশিয়ার কোনো উদ্যোগী ভূমিকা দেখছি না। আর যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে জড়িয়েই যায়, তখন যে তারা উদ্যোগী হবে তারও নিশ্চয়তা দেখছি না। ইরান প্রকৃত পক্ষে একাই লড়ে যাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতে জড়ালে যুদ্ধটা আরো ঘনীভূত হবে। কিন্তু এমন কোনো দৃশ্যমান ইঙ্গিত নেই, যাতে করে বুঝতে পারব যে এখানে ইরানের পক্ষে রাশিয়া বা চীন এসে দাঁড়াবে।

প্রশ্ন : আলোচনা আছে, মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতি তাইওয়ান ও ইউক্রেন দখলে চীন ও রাশিয়াকে উসকে দিতে পারে। আপনি কী বলবেন?

উত্তর : এ নিয়ে আমিও চিন্তা করেছি। ইরান আক্রমণে যুক্তরাষ্ট্র যদি যোগ দেয় তাহলে নৈতিকভাবে তারা রাশিয়ার ওপর কথা বলার অধিকার হারাবে। এর অর্থ ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার তখন অ্যাডভান্টেজ পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়বে। আবার এই মুহূর্তে যদিও তাইওয়ানের ব্যাপারে কোনো আশঙ্কা নেই, কিন্তু ভবিষ্যতে এটি চীনের জন্য রসদ জোগাবে।

প্রশ্ন : ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়ার যুদ্ধের ক্ষেত্রে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছিল, এখন ইরানের ক্ষেত্রে পারমাণবিক হুমকির কথা বলা হচ্ছে। বাস্তবে এসবের প্রমাণ নেই। মূল কারণটা কি ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ, ঐতিহাসিক শত্রুতা, নাকি আঞ্চলিক ক্ষমতার ভারসাম্য?

উত্তর : পাশ্চাত্যের সঙ্গে ইরানের দ্বন্দ্বের ইতিহাসটা পুরনো। এটি একসময় বাণিজ্যিক ছিল। গত শতাব্দীর পঞ্চাশ থেকে আশির দশকে এটি আদর্শিক রূপ নেয়। ইরাক যুদ্ধের পর থেকে এটি আবার ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এবার কোনো কারণে যদি ইরান হেরে যায় বা সরকার পরিবর্তনের মতো ঘটনা ঘটে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

প্রশ্ন : মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ কি নিন্দা জানিয়েই সীমাবদ্ধ থাকবে? মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোর ওপর এই সংঘাতের প্রভাব কোনোভাবে পড়তে পারে?

উত্তর : ওই দেশগুলোতে তো রাজতন্ত্র। তারা রাজত্ব করতেই থাকবে। আর ইরানে যদি নতুন সরকারও গঠিত হয়, তখনো দেশগুলো রাজত্ব করতে থাকবে। ইরান সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, ইরান কিন্তু একটা সিভিলাইজেশন স্টেট। ইরানের সঙ্গে পশ্চিমা জগতের প্রতিদ্বন্দ্বিতা আজকের নয়। অনেক জেনারেশন ধরে এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা চলে আসছে। ফলে তাদের একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে বলে আমার কাছে মনে হয় না। ইরানের শাসনক্ষমতায় যে-ই থাকুক, অন্য দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক যে রকম আছে সেগুলো তারা চালিয়ে যাবে। এটা হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতা এবং ইসরায়েল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সেই গ্যারান্টি দেয়—তোমরা যদি আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখো তাহলে স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে না। কিন্তু ইরান বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে, ইরান এটা করে দেবে, ওটা করে দেবে—এই ন্যারেটিভগুলো কিন্তু পাশ্চাত্য জগতে ভালো চলে না। মধ্যপ্রাচ্যের যে রাজারা আছেন তাঁরাও এটা চান না। ইরানের বর্তমান সরকার থাকা বা যাওয়ার ফলে মোটাদাগে মধ্যপ্রাচ্যের যে স্থিতাবস্থা আছে, তার কোনো পরিবর্তনের ইঙ্গিত এখনো দেখছি না।

প্রশ্ন : ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ বিশ্ববাণিজ্যে কী প্রভাব ফেলবে? তেলের দাম কি আরো বাড়বে বলে মনে করেন?

উত্তর : যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত না হয় তাহলে খুব বেশি কিছু হবে না। কিন্তু যদি ইরাকের মতো দীর্ঘমেয়াদি সংঘাত চলতে থাকে তাহলে তেলের দাম বাড়বে। অথবা ইরান যদি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে হরমুজ প্রণালি বন্ধ করে দেয়, তাহলে বিপদ হবে। সেটা হলে তো আমাদের মতো দেশগুলোর জন্যও বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। এসব জায়গা দিয়েই তো আমরা বাইরে আমেরিকা, ইউরোপে এক্সপোর্ট করি। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রশ্ন : আমাদের জনশক্তি রপ্তানির একটা বড় অংশের গন্তব্য মধ্যপ্রাচ্য। সেখানেও তো প্রভাব পড়বে। গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স—দুটি খাতই বিপদে পড়তে পারে বলে মনে করেন কি?

উত্তর : যুদ্ধ যদি চলতে থাকে তাহলে আমাদের লোক যাঁরা সেখানে আছেন তাঁদের কিভাবে সরাব সে চিন্তা তো আছেই, যেমন—ইরানে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের নিয়ে আমরা ভাবছি। আর যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে আমাদের লোকগুলোকে সরাতে হবে ফিজিক্যালি। এটি মানবিক সমস্যা। তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠান। সেটাও তো বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের তো ডাবল সমস্যা। অন্যদিকে আমাদের রেমিট্যান্স কমবে। এটা তো আমাদের জন্য একটা বিপদের আশঙ্কা। বহুমুখী বিপদ।

সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Categories: জাতীয়
Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings