কোটা আন্দোলনের সূত্র ধরে ছাত্র-জনতার ২৪ এর জুলাই গণঅভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হলেও এর কারণ অনেক গভীরে। হঠাৎ করেই মানুষ রাস্তায় নামে নাই। হঠাৎ করেই ছাত্ররা কোটা আন্দোলন শুরু করে নাই বা সাধারণ মানুষ জীবনের মায়া ত্যাগ করে রাস্তায় আসে নাই। একটু পিছন ফিরে তাকালে ২০০১ বা ২০০২ সালে কোটা আন্দোলন শুরুর প্রথম দিকে আমরা একবার প্রেসক্লাবে জমায়েত হয়েছিলাম। আমার মনে আছে একটি সমাবেশে আমি কোটাবিরোধী আন্দোলনে বক্তব্যও রেখেছিলাম। তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে চাকুরির পরীক্ষা দিচ্ছিলাম। বিগত ২৪ এর আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে যা হয়েছিল-একদিকে দূর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে (সরকারী ও বেসরকারী) চাকুরির বাজার সয়লাব অন্যদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারের একটানা অতিরিক্ত ফান্ড সংগ্রহের ফলে বেসরকারি খাতে ঋন প্রবাহ কমে যাওয়া (এটাকে অর্নীতির ভাষায় Crowding Out effect বলে) ও প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার ফলে বেসরকারি চাকুরির সুযোগ যাওয়া। অপরদিকে, লুটপাট ও চাঁদাবাজী ও অতি মুনাফা খোরদের দাপটে মুদ্রাস্ফীতি বা দ্রব্য মূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ জনগনের নাভিশ্বাস উঠে গিয়েছিল যা দ্রুত জন বিস্ফোরণে রূপ নেয়। সুতরাং জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পিছনে যে অর্থনৈতিক কারণ ছিল তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সে কারণে সবার আগে আমাদের অর্থনৈতিক গতি ও স্থিতিশীলতা প্রয়োজন আর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বা মুক্তি যাই বলি, না হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা সূদুরপরাহত- এই চরম সত্য যত তাড়াতাড়ি আমাদের রাজনীতিবিদরা বা দল এবং প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করবেন এবং প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্হা গ্রহণ করবেন, তত তাড়াতাড়ি জাতির কল্যান হবে। বিগত সরকার অর্থনীতির উন্নয়নে সবই তো করেছিল বড় বড় প্রজেক্ট, পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল রেল, কর্নফুলী টানেল প্রভৃতি কিন্তু সমস্যাটা কোথায় কমে ছিল? অর্থনীতির মূল স্তম্ভ বলা হয়ে থাকে ব্যাংকিং খাত যার নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক। উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের উপর কর্তৃত্ব স্হাপনের মাধ্যমে ব্যাংক দখল, লুটপাট, নিয়োগ বানিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করে অর্থনীতির মূল শক্তিকে করা হয়েছিল পঙ্গু। টাকা ছাপিয়ে ব্যাংক বাচানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টাও ছিল-এখন একদিকে আমানতকারীরা টাকা পাচ্ছেন না- আবার যারা বিনিয়োগকারী অর্থাৎ এসএমই উদ্যোক্তাগনও তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণ/ বিনিয়োগ পাচ্ছেন না। ব্যাংকিং খাতের এই নাজুক অবস্হার জন্য দায়ী এক কথায় বিগত সরকারের একরোখা দূর্নীতিপরায়ন ও লোভী নীতি ও নিয়ন্ত্রণ। তাহলে, সমাধান কী? এর সমাধান-বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্বশাসন দিয়ে জনগনের কাছে দায়বদ্ধ করা। বাংলাদেশ ব্যাংককে রাজনৈতিক ও প্রশাসনের প্রভাবমুক্ত রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আওতায় ব্যাংকিং খাতকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
অর্থনীতিবিদ জনাব কামরুল ইসলাম ও জিয়া হাসান কলামটিতে লিখেছেন: “কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতা ও পেশাদারত্ব অপরিহার্য, যা রাজনৈতিক প্রভাব-মুক্ত না হলে বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হলে স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক স্বার্থে বা গোষ্ঠী স্বার্থে টাকার অতিমুদ্রণ, ঋণনীতি শিথিলকরণ বা আর্থিক খাতে পক্ষপাতিত্বমূলক তদারকি হতে পারে, যা মুদ্রার প্রকৃত মূল্যহ্রাস, মজুরি হ্রাস, খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি বৃদ্ধি, আমদানি-রপ্তানিতে সংকট, মুদ্রা পাচার, স্বজনতোষী ধনতন্ত্র (ক্রনি ক্যাপিটালিজম) তৈরি ও ঋণ কেন্দ্রীভূতকরণের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ধীরে ধীরে বাজার থেকে বিতাড়িত করতে পারে। ফলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে, বৈষম্য কমাতে ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যকর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।” অত্যন্ত দঃখজনক হলেও সত্য যে জুলাই আন্দোলনের পিছনে এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সংস্কার কমিশনের নজরে আসেনি এবং এটা নিয়ে কোনো পরিকল্পনাও নেই যা হতাশাজনক। অন্যদিকে আমাদের প্রশাসনেরও বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়ে অনীহা লক্ষনীয়। বার বার ইস্যূটা আলোচিত হলেও তা প্রশাসনের বাঁধার কারনে বাস্তবায়িত হয়নি! কিন্তু কেন? কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ভাল হলে রাজনীতিক দল বা প্রশাসনের কি ক্ষতি আছে? সুস্হ ব্যাংক ও আমানতের সুরক্ষা হলে এবং উদ্যোক্তাগন তার মূলধনের সরবরাহ পেলে অর্থনীতি সমৃদ্ধি হলে জনগনের লাভ না ক্ষতি? বিচার আপনাদের কাছেই দিলাম। Pearls dont lie on the seashore. If you want one, you must dive for it.
লেখক :নজরুল ইসলামের