X

বিনামূল্যে পাঠ্যবই ছাপাতে সরকারের গচ্চা বিপুল টাকা

সিন্ডিকেটের কারণে এবার বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে সরকারের গচ্ছা গেছে বিপুল টাকা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৩৯ কোটি ৬০ লাখ বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপাতে দুই সিন্ডিকেট দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি লুটপাট করেছে। তার মধ্যে ছাপাখানাগুলোর সিন্ডিকেট দরে সরকারের অতিরিক্ত প্রায় ৮০০ কোটি টাকা গচ্চা এবং কাগজ মিল মালিকরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে কাগজের দাম বাড়িয়ে ৩৪৫ কোটি টাকা হাতিয়েছে। পাশাপাশি এক শ্রেণীর ছাপাখানা সরকারি নির্দেশনা উপেক্ষা করে নি¤œমানের কাগজে প্রায় ২০ ভাগ পাঠ্যবই ছাপিয়ে সরবরাহ করেঝে। তার মাধ্যমে ওই সব মুদ্রাকররা ৩৫৫ কোটি টাকার অধিক মুনাফা করেছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) প্রাক্কলিত দরের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি দরে এবার প্রেস মালিকরা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) অনুযায়ী বই ছাপার কাজ বাগিয়ে নেয়। প্রতিটি প্রেস মালিকরা প্রাক্কলিত ব্যয়ের থেকে ১৯ দশমিক ১, ১৯ দশমিক ২ কিংবা ২০ শতাংশ বাড়িয়ে টেন্ডার জমা দেয়। আর প্রায় ৪০ ভাগ টেন্ডারে একজনের বেশি টেন্ডার জমা দেয়নি। মূলত প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেট স্বল্প সময়ে কাজের চাপ বেশি থাকার সুযোগ নিয়েছে। ফলে সিন্ডিকেট সম্পর্কে বুঝতে পারলেও এনসিটিবি দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। যদিও প্রেস মালিকদের অজুহাত, বাজার দর বেড়ে যাওয়ায় তাদের তেমন করণীয় ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, যেসব প্রেস বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপার কাজ করে, সেগুলোর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান মালিকই সাবেক সরকারের সময়ে সিন্ডিকেট করে দরপত্রে কম দর দিয়ে বইয়ের কাজ বাগিয়ে নিতো। তারপর দিতো নি¤œমানের কাগজের বই। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তসের পর সব প্রেস মালিকই একজোট হয়ে যায়। বই ছাপানোর জন্য এনসিটিবি অনুমোদিত ১১৬টি প্রেস রয়েছে। গত বছর যেখানে নতুন পাঠ্যবই বাবদ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছিল। এবার সেখানে ২ হাজার কোটির বেশি খরচ হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিনামূল্যের বই ছাপাতে প্রেস মালিকরা এবার সরকারের দুর্বলতার সুযোগ নিয়েছে। বই ছাপানোর ক্ষেত্রে সময় কম থাকায় ফের দরপত্র করার মতোও সুযোগ না থাকার কারণে প্রেসগুলোকে প্রতিটি শ্রেণিতে ২০ শতাংশের মতো বেশি দামে কাজ দিতে হয়েছে। তাতে ধারণার চেয়ে প্রায় ৭৮৩ কোটি টাকা বেশি দিতে হয়েছে। তাছাড়া পুরোনো কারিকুলামে ফিরে যাওয়ার ফলে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণে অনেক পরিবর্তন আসে। তাছাড়া আগে দশম শ্রেণির বই দেয়া হতো না, কিন্তু এবার তা দিতে হয়েছে। ফলে এখানে নতুন করে ছাপতে হয়েছে প্রায় ৬ কোটি ৪৪ লক্ষ বেশি বই। পাশাপাশি বইয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি, কারিকুলাম পরিবর্তনের কারণে কাজের পরিধি বাড়লেও ছাপার ক্ষেত্রে সময়ের স্বল্পতা ছিল।

সূত্র আরো জানায়, টেন্ডারের সব শর্ত মেনে পাঠ্যবই ছাপার ঠিকাদারি নিলেও কাগজের পুরুত্ব (মোটা), ব্রাইটনেস (উজ্জ্বলতা) ও টেকসই ক্ষমতা (বার্স্টিং ফ্যাক্টর) কিছুই প্রায় ২০ ভাগ পাঠ্যবইয়ে মানা হয়নি। নিম্নমানের কাগজে বই ছাপতে গিয়ে গত দুটি প্রেস ৫ ডিসেম্বর হাতেনাতে ধরা পড়ে। তাছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট প্রেসগুলো নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যবই বেশি ছাপিয়েছে। তবে নি¤œমানের কাগজের বিষয়ে যাদের সম্পৃক্ততা ছিলো তাদের অর্থ ছাড় বন্ধ রাখা হয়েছিল। তাছাড়া নির্ধারিত সময়ে বই না দেয়ার কারণে এবার ২৬টি ছাপাখানা কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু পরবর্তীতে অজানা কারণে বিল ছাড় এবং কালো তালিকাভুক্ত থেকে ওসব প্রতিষ্ঠানকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। বিনামূল্যের বই ছাপাতে এবার যদিও বিশেষ ব্যবস্থায় কাগজ আমদানি করা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর অধিকাংশ খোলা বাজারে বিক্রি করে এক শ্রেণীর ছাপাখানার মালিক নিম্নমানের কাগজে বই ছাপিয়েছে।
এদিকে মুদ্রণ শিল্প সমিতির নেতারা ইচ্ছাকৃতভাবে বেশি দরে কাজ নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, এনসিটিবি নিজেদের মতো করে একটা প্রাক্কলিত দর ঠিক করে। আগের বছরগুলোয় যে দর ছিল, একই দরে এ বছরও প্রাক্কলিত দর নির্ধারণ করা হয়। ড্ বাস্তবসম্মত নয়। ফলে তাদের নির্ধারিত দরে কাজ করা সম্ভব হয়নি। তাছাড়া এ বছর কাগজসহ ছাপার কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন উপাদানের দাম, ব্যাংক ঋণের হার ও ট্যাক্সের পরিমাণ গতবারের তুলনায় অনেক বেশি ছিলো। স্বল্প সময়ে অধিক বই মুদ্রণের ফলে আনুষঙ্গিক ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে দর আগের চেয়ে বেড়েছে। এখানে প্রেস মালিকদের সিন্ডিকেটের বিষয় নেই।
অন্যদিকে কাগজের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে এবার ৩৪৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাগজের মূল্য না বাড়লেও চলতি বছর দেশের কাগজের মিল মালিকরা পাঠ্যবই ছাপানোর মৌসুমে কাগজের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি করে। গত ডিসেম্বরে হঠাৎ করে প্রতি টন কাগজের মূল্য ৩০ হাজার টাকা বাড়ে। ৩৯ কোটি ৬০ লাখের বেশি পাঠ্যবই ছাপাতে প্রয়োজন ছিল ১ লাখ ১৫ হাজার টন কাগজ। ওই হিসাবে কাগজ মিলের মালিকরা ওই বাড়তি টাকা হাতিয়ে নেয়। আবার বেশি দাম দিয়েও পাঠ্যবই ছাপানোর দায়িত্বে থাকা দেশের ১১৬ ছাপাখানা চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পায়নি। যে কারণে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছাতে দেরি হয়েছে। কাগজ সংকটের কারণে অধিকাংশ ছাপাখানা টানা তিন মাস প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা ছাপা বন্ধ রেখেছিল। তখন কাগজের মিল মালিকদের সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে ১০টি ছাপাখানার মালিক সরকারকে কাগজ আমদানির অনুমতি দেয়ার দাবি জানিয়েছিলো। শুল্কমুক্ত কাগজ আমদানির সুযোগ চেয়ে গত ২০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির পক্ষ থেকে চিঠি দেয়া হয়। চিঠিতে শুল্কমুক্ত কাগজ, আট কার্ড আমদানির সুবিধা প্রদান বিষয়ে বলা হয়েছে, এনসিটিবির প্রত্যায়নের ভিত্তিতে শুধু কার্যাদেশপ্রাপ্ত মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো এবং যে সব মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান সরাসরি মুদ্রণ কাগজ আমদানি করতে পারে না তাদের জন্য এনসিটিবির তত্ত্বাবধানে আমদানিকারক নিযুক্ত করে শুল্কমুক্ত কাগজ ও আট কার্ড আমদানি করে বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক ছাপার সুযোগ পায়, সেই ব্যবস্থা রাখার বিনীত অনুরোধ করছি।
এ বিষয়ে এনসিটিবির চেয়ারম্যান (রুটিন দায়িত্ব) অধ্যাপক রবিউল কবীর চৌধুরী জানান, পাঠ্যবই ছাপার কাজ শুরু হলে কাগজের সংকট হয়। সেজন্য এবার কিছু কাগজ আমদানি করা হয়েছে। তবে ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের বই ছাপার সময় ওই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকবে কিনা সেই বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

Categories: জাতীয়
Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings