ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে সংঘবদ্ধ দালাল ও চোর-ছিনতাইকারীরা সক্রিয়। যার কারণে রোগী ও স্বজনদের চরম ভোগান্তিতে ভোগছেন। অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেটের কারণে ঢাকায় রেফার্ড করা গরীব রোগীদের চরম বিপাকে পড়তে হয়। এসব কারণে বিপাকে রয়েছেন রোগী ও তার স্বজনরা। সংঘবদ্ধ দালালরা সরকারি এই হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে এক রোগীকে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভর্তি করালে দুই-তিন হাজার টাকা কমিশন পায় দালালরা। অপর দিকে হাসপাতালের ওয়ার্ডের ভেতরেই ঘটছে চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা। এসব নিয়ে সবসময় আতঙ্কে থাকেন রোগীরা।
ভূক্তভোগী রোগী ও স্বজনরা জানিয়েছেন, দিনরাতে হাসপাতালে দালাল চক্রের সদস্যদের দেখা যায়। দালালরা হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ওয়ার্ড কিংবা জরুরি বিভাগের সামনে থেকে নিয়ে যায় প্রাইভেট হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে গিয়ে রোগীরা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন। পাশাপাশি চোর-ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা হাসপাতালের আউটডোর এবং ওয়ার্ডে ঢুকে রোগী ও স্বজনদের কাছ থেকে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইলসহ জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
দালালের কাছে প্রতারিত হওয়া রোগীর স্বজন জেলার ফুলপুর উপজেলার সাহাপুরের কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার ভাবি সাহেলা বেগমের সন্তান প্রসবের জন্য গত ২০ নভেম্বর সন্ধ্যার দিকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাই। জরুরি বিভাগের চিকিৎসককে দেখানোর পর ভর্তি টিকিট নিয়ে হাসপাতালের ওয়ার্ডে ঢোকার সময় দালাল চক্রের তিন সদস্য এগিয়ে এসে বলে রাতে হাসপাতালে ডাক্তার থাকেন না, অপারেশন হয় না। এখন অপারেশন না করালে নবজাতকের ক্ষতি হবে। এমন ভয় দেখিয়ে আমাদের হাসপাতালের সামনের প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি হয়ে অপারেশন করানোর কথা বলে। আমার বড় ভাই সহজ-সরল মানুষ। দালালদের কথা শুনে তাদের সঙ্গে চলে যান হাসপাতালের সামনের গলির জননী নার্সিং হোমে। সেখানে ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে ভাবিকে ভর্তি করার পর রাতেই সিজারিয়ান অপারেশন করা হয়। পরে ক্লিনিক ও দালালরা নানা কথা বলে আরও ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়ে রোগীকে রিলিজ করে দেয়। আমার ভাবি এখনও সুস্থ হননি। তিন দিন আগে তাকে ফুলপুরের এক গাইনি চিকিৎসককে দেখালে জানান, দামি ইনজেকশনসহ অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ায় রোগী এখনও সুস্থ হয়নি। প্রতারণার শিকার জেলার ধোবাউড়া উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া গ্রামের অটোরিক্সাচালক আব্দুস সালাম বলেন, ‘আমার শ্বশুর আব্দুল করিমের (৬৫) পিত্তথলিতে পাথর এবং পেটব্যথা হওয়ায় ময়মনসিংহ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি করাই। ভর্তির পর চিকিৎসক বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেন। চিকিৎসা চলতে থাকে। এর মধ্যে চিকিৎসক বলেন অপারেশন করতে কিছুদিন সময় লাগবে, একটু ধৈর্য ধরেন। পরে হাসপাতালের সামনে চরপাড়া এলাকার রাজীব হোসেন নামে এক দালালের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। ওই দালাল আমার শ্বশুরকে অনেক কিছু বোঝায়। দালাল বলেছিল হাসপাতালে যে ডাক্তার আপনাকে দেখেছেন, তিনি বাইরের ক্লিনিকে অপারেশন করবেন। যেদিন করাতে চান সেদিনই করবেন। সরকারি হাসপাতালের ওয়ার্ডে মাসের পর মাস অপারেশনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দালালের কথা শুনে আমার শ্বশুর অস্থির হয়ে যান। ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতে অপারেশনের জন্য দালাল আমার শ্বশুরকে হাসপাতালের সামনের চরপাড়া একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। ওই দিন রাতেই অপারেশন করা হয়। রক্ত ও দামি ওষুধ দেওয়ার কথা বলে আরও পাঁচ হাজার টাকা হাতিয়ে নেন হাসপাতালের মালিক। তিন দিনের মাথায় শ্বশুরকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।’ শুধু দালাল নয়, হাসপাতালের আউটডোর এবং ইনডোরে চোর-ছিনতাইকারীদের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন রোগী ও স্বজনরা। চোর চক্রের সদস্যরা বিশেষ করে নারীরা বোরকা পরে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে যায়। তারপর আউটডোরের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা রোগী ও স্বজনদের ব্যাগ থেকে কৌশলে টাকা, মোবাইল এবং গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। একইভাবে ওয়ার্ডের ভেতরে চক্রের সদস্যরা রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করে কৌশলে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার এবং মোবাইলসহ জিনিসপত্র নিয়ে যায়।
হাসপাতালে আসা এক রোগীর স্বজন ফয়সাল আহমেদ বলেন, ‘গত সপ্তাহে আমার ভাবি শেফালী আক্তার পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালের ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ভর্তি হন। ওয়ার্ডে জায়গা না পেয়ে বারান্দায় বিছানা পেতে চিকিৎসা নেন। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘুমিয়ে পড়ায় তার ব্যাগ থেকে টাকা ও মোবাইল চুরি করে নিয়ে যায় চোরেরা। পরে শুনেছি আরও কয়েকজনের মোবাইল ও টাকা চুরি হয়েছে। এরকম প্রায়ই দিন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের টাকা, মোবাইল ও জিনিসপত্র চুরির ঘটনা ঘটছে।’
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রায়ই চোর চক্রের সদস্যদের আটক করছি। পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নিয়ে নিয়মিত তধারকি চলছে।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) চিকিৎসক মাইন উদ্দিন খান বলেন, প্রতিদিন তিন-চার হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। প্রতিদিন আউটডোরে তিন থেকে চার হাজার রোগী চিকিৎসা নেন। রোগীদের সঙ্গে একজন কিংবা দুজন করে স্বজন আসছেন। এত মানুষের ভিড়ে চোর চক্রের সদস্য সক্রিয় থাকে। আমরা তা নিরসনে পুলিশ ও আনসার সদস্যদের সমন্বয়ে কাজ করে যাচ্ছি।