চলতি মৌসুমে রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন আম উৎপাদনকারী জেলা থেকে প্রায় ৪০ হাজার টন আম রপ্তানিযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত হলেও রপ্তানিতে দেখা দিয়েছে বড় ধরনের ভাটা। মৌসুম প্রায় শেষের পথে, কিন্তু এখন পর্যন্ত রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৭৮০ টন। এতে চরম হতাশ রাজশাহী অঞ্চলের চাষিরা, যারা রপ্তানির আশায় অতিরিক্ত খরচ করে আম উৎপাদন করেছেন। তারা অনেকেই এখন বিপাকে পড়েছেন।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর আম রপ্তানির প্রাথমিক লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ হাজার টন। কিন্তু রপ্তানি হওয়া আমের পরিমাণ এর ধারে-কাছেও পৌঁছায়নি। ২০২৩ সালে রপ্তানি হয়েছিল সাড়ে ৩ হাজার টন আম। তার আগের বছর রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ১ হাজার ৩২১ টন।
চাষিরা বলছেন, রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদনের জন্য সরকারি প্রকল্প থাকলেও এর সুফল রাজশাহীর চাষিরা পাচ্ছেন না। গ্যাপ (গুড অ্যাগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস) পদ্ধতিতে চাষ করতে গিয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, অথচ ওই বাড়তি খরচ তুলতে পারছেন না তারা। চাঁপাইনবাবগঞ্জ ম্যাঙ্গো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব আহসান হাবিব বলেন, ‘গ্যাপ পদ্ধতিতে উৎপাদনে বাড়তি খরচ হয়। এবার আমাদের জেলায় ১০৭ জন চাষি রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করেছেন।’
রাজশাহীর বিপন অ্যাগ্রো প্রোডাক্টসের হাফিজুর রহমান বলেন, ‘নিরাপদ প্যাকিং, গ্রেডিং আর রপ্তানির পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় আম পাঠানো কঠিন হয়ে পড়েছে।’ চাষিরা বলছেন, রাজশাহীতে প্যাকিং হাউজ, হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট ও রপ্তানি সহায়ক অবকাঠামো গড়ে না তুললে এ খাতে টিকে থাকা কঠিন হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংযোগ তৈরিতেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই।
রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের পরিচালক আরিফুর রহমান বলেন, ‘চলতি বছর আমরা ৫ হাজার টন রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিলাম। আশা করছি, ৪ হাজার টন রপ্তানি সম্ভব হবে। এখনো দুই মাস সময় আছে।’ তবে রাজশাহী অঞ্চলের পরিসংখ্যান বলছে ভিন্ন চিত্র। গত তিন অর্থবছরে এ অঞ্চলে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে ৪ হাজার ৬৪৮ টন। কিন্তু রপ্তানি হয়েছে মাত্র ১ হাজার ২৭ দশমিক ৮৮ টন। যেটা মোট উৎপাদনের ২২ দশমিক ১১ শতাংশ মাত্র।
২০২১-২২ অর্থবছরে রপ্তানিযোগ্য আম হয়েছিল ৫৫০ টন। রপ্তানি হয়েছিল ২২২ দশমিক ৮৮ টন। যেটা ৪০ দশমিক ৫২ শতাংশ।
২০২২-২৩ অর্থবছরে উৎপাদন বেড়ে হয় ২ হাজার ৫২৮ টন, কিন্তু রপ্তানি হয় মাত্র ৬০৬ টন (২৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ)। আর
২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ৫৭০ টনে। এ সময় রপ্তানি হয় মাত্র ১৯৯ টন। যেটা ১২ দশমিক ৬৮ শতাংশ।
চাষি ও কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আম রপ্তানির প্রধান অন্তরায় হলো ‘ফাইটোস্যানিটারি সার্টিফিকেট’ জটিলতা। বিদেশে আম পাঠাতে স্বাস্থ্য সনদ বাধ্যতামূলক হলেও এটি পেতে জটিলতা ও বিলম্ব হয়। এ ছাড়া হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নেই রাজশাহীতে। ইউরোপসহ অনেক দেশ রপ্তানির আগে হট ওয়াটার ট্রিটমেন্ট বাধ্যতামূলক করে। যেটা কেবল ঢাকায় পাওয়া যায়।
সংরক্ষণের সঠিক ব্যবস্থা না থাকা, শীতলীকরণ সুবিধার অভাব, মানসম্মত প্যাকেজিং ও গ্রেডিংয়ের অভাব, উচ্চপরিবহন ব্যয়- সব মিলিয়ে রপ্তানি কার্যক্রম ভেঙে পড়েছে। বিশেষ করে কার্গো বিমানের অভাবে প্রতি কেজি আম পাঠাতে ৫০০ টাকা খরচ হয়। যেটা চাষিদের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে সালমা বলেন, ‘রাজশাহী থেকে এবারও আম রপ্তানি খুবই কম হচ্ছে। নিজস্ব কার্গো বিমান না থাকায় প্রতি কেজি আম পাঠাতে খরচ পড়ে ৫০০ টাকা। যেটা চাষিদের জন্য ভীষণ চাপের।’ চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. ইয়াছিন আলী বলেন, ‘রাজশাহী অঞ্চলের সবচেয়ে বেশি রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন হয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায়। প্রায় ৬ হাজার টন আম উৎপাদন হয়েছে। ইতোমধ্যে ১৭ টন আম রপ্তানি হয়েছে। ঈদের ছুটির কারণে কিছুদিন বন্ধ ছিল, আবার শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা গত বছর ৩৩০ টন রপ্তানি করেছিলাম। এবার ৫০০ থেকে ৭০০ টন পাঠানোর চেষ্টা করব। বাকি আম দেশের বিভিন্ন সুপারশপে পাঠানো হবে।’
চাষিরা বলছেন, শুধু উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, রপ্তানির জন্য প্রয়োজন সরকারি সহায়তায় অবকাঠামো উন্নয়ন, প্রক্রিয়াকরণ সুবিধা ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সেতুবন্ধন। না হলে রাজশাহীর আম রপ্তানির স্বপ্ন লোকসানে পরিণত হবে।