৫ আগস্ট রাজশাহী সিটি করপোরেশনে ভাঙচুর ও অগ্নিকান্ড ক্ষতিগ্রস্ত নগর ভবনের সংস্কারকাজ চলছে। তবে এ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে প্রায় অর্ধকোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। রিকুয়েস্ট ফর কোটেশন মেথডে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত কাজ বিনা টেন্ডারে করা যায়। কিন্তু সেখানে তিনিটি ঠিকাদারকে ইতোমধ্যেই প্রায় ২০ লাখ টাকা পরিষদ করেছে সিটি করপোরেশন।
এ কাজের অনিয়ম খতিয়ে দেখতে নগর ভবনে হানা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি টিম। তারা কয়েকটি দপ্তরে যান এবং ফাইলপত্র খতিয়ে দেখেন। বৃহস্পতিবার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইনের নেতৃত্বে এই এনফোর্সমেন্ট অভিযান পরিচালিত হয়। অভিযানে ছিলেন দুদকের সহকারী পরিচালক তানভীর আহমেদ সিদ্দীক এবং উপসহকারী পরিচালক মাহবুবুর রহমানও।
অভিযান শেষে দুদক জানিয়েছে, কাজ ইতোমধ্যে অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে। বেশিরভাগ কাজের ঠিকাদার নির্বাচন সংক্রান্ত কাগজপত্র দেখাতে পারেনি সিটি করপোরেশন। আবার যেসব কাগজ দিয়েছে তার একটি যাচাইয়ের জন্য ঠিকাদারের মোবাইল নম্বর হিসেবে উল্লেখ থাকা নম্বরটিতে ফোন করে দুদক দেখেছে, নম্বরটি কোন ঠিকাদারের নয়। তিনি চাঁদপুরের এক ব্যক্তি।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর পরই সিটি করপোরেশনে তাণ্ডব চালানো হয়। লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয় নগর ভবনে। এতে ২১ কোটি ১১ লাখ ৬৫ হাজার ৪৯ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। সম্প্রতি এসবেরই সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু নিয়ম-নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, জেলা যুবদলের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ও নগরের দড়িখড়বোনা এলাকার বিএনপি নেতা ইয়াহিয়া খান মিলু সিংহভাগ কাজ করছেন। ইতোমধ্যে নগর ভবনের রং করার কাজ শেষ হয়েছে। লাগানো হয়েছে নতুন গ্লাস। এখন প্রায় ৫০ লাখ টাকা খরচ করে মেয়রের দপ্তর সংস্কার করা হচ্ছে। তবে কাজের কোন টেন্ডার হয়নি। ‘রিকুয়েস্ট ফর কোটেশন মেথোডে’ কাজ করার কথা বললেও কাগজপত্রই প্রস্তুত করতে পারেনি নগর ভবন। এর আগেই কাজের অর্ধেক সম্পন্ন হয়ে গেছে।
বৃহস্পতিবার দুদক কর্মকর্তারা অভিযানে গেলে দীর্ঘ সময় তাদের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে বসিয়ে রাখা হয়। পরে বিল দেওয়া হয়েছে এমন তিনটি কাজের কাগজপত্র দেওয়া হয় দুদক দলকে। আর চলমান সাতটি কাজের কোন কাগজপত্রই সরবরাহ করতে পারেননি তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। কার্যাদেশ ছাড়াই ঠিকাদার কীভাবে কাজ করছেন তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
দুপুরে অভিযান শেষে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আমির হোসাইন বলেন, তারা ফরিদা ইয়াসিমন, মাইসা এন্টারপ্রাইজ এবং শাহরিন এন্টারপ্রাইজ নামের তিনটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কাগজ পেয়েছেন। মাইসা এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী ইয়াহিয়া খান মিলু। শাহরিন এন্টারপ্রাইজের কাগজপত্রে স্বত্ত্বাধিকারী হিসেবে এমএম মাহফুজুর রহমান নাম লেখা আছে। তবে মোবাইল নম্বরে ফোন করে দেখা গেছে, নম্বরটি তার নয়। চাঁদপুরের এক ব্যক্তি ফোন ধরে বলেছেন, তিনি ঠিকাদার নন। কোন দরপত্রেও অংশ নেননি।
আমির হোসাইন বলেন, আব্দুল মালেক ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১১৫ টাকার কাজ করছেন। এ কাজের কটেশনে অংশ নেন তার স্ত্রীর নামে প্রতিষ্ঠান সামিয়া ইন্টারপ্রাইজ। তিনটি কাজেই আব্দুল মালেক ইন্টারপ্রাইজ, সামিয়া ইন্টারপ্রাইজ ও শাহরিন ইন্টারপ্রাইজ কটেশন জমা দেয়। এই তিনটি প্রতিষ্ঠান একই পরিবারের বলে জানা গেছে।
শাহরিন এন্টারপ্রাইজ ৫ লাখ ৪৫ হাজার ৩৪০ টাকার কাজ করেছে। এই কাজের কাগজ জাল হিসেবে মনে করা হচ্ছে জানিয়ে দুদক কর্মকর্তা আমির হোসাইন বলেন, ‘যারা কাজ পেয়েছে একই ব্যক্তি মনে হচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর আলাদা আলাদা নামে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। কাছাকাছি দর দাখিল করেছে। তারা কাজ পেয়েছে। পিপিআর অনুযায়ী প্রতিযোগিতা হতে হবে। এখানে সঠিক প্রতিযোগিতা হয়েছে বলে আমাদের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মান হয়নি। রং, গ্লাস ও থাই লাগানো এবং দরজা লাগানোর তিনটি কাজ একই ভাবে দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘কাগজ দেওয়ার জন্য আমাদের দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছেন। কিন্তু মাত্র তিনটা ফাইল তারা আমাদের দিয়েছেন। আর আমরা ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, এখনও সাতটা কাজ চলমান। সিটি করপোরেশন তিনটি কাজের ফাইল দিতে পেরেছে। কিন্তু এই সাতটা কাজের কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। অলরেডি কাজের হাফ ডান।’
গাইড লাইন মেনে ঠিকাদারদের কাজ দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেন ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহমদ আল মঈন। তিনি বলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে নিজস্ব তহবিল থেকে তারা এ সংস্কার কাজ করছেন। এতে কোন অনিয়ম হয়নি। সময় দিলে বাকি ফাইলগুলো দেওয়া হবে।
তিনি বলেন, একই পরিবারের অন্য সদস্যরাও ব্যবসা করতে পারেন। এতে দোষের কিছু নেই। এক পরিবার থেকে একাধিক ঠিকাদার কটেশন দিলেও সেটি নিয়মের মধ্যে দিয়েছেন। তাই তাদের কাজ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও যেহেতু সিটি করপোরেশনের ফান্ডে টাকা নেই সে ক্ষেত্রে অনেকেই বিল পাবেনা বলে এ কাজ করতে আগ্রহি হয়নি বলেও মন্তব্য করে এই কর্মকর্তা।