X

শীতলপাটি ও জুটের অর্ধশত পণ্য

উদ্যোক্তা ফরিদা পারভীন একজন কৃষিবিদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কৃষি’তে অনার্স ও ‘পরিবেশ বিজ্ঞান’ নিয়ে মাস্টার্স করেছেন। ছোটবেলা থেকে এমন কিছু করতে চাইতেন, যে কাজটা করলে তার সাথে আরও কিছু মানুষের জীবন পরিবর্তন হবে। যখন তিনি এটা ভাবছিলেন, তখন ব্যবসা বা উদ্যোক্তা এই ব্যাপারটা বুঝতেন না। তবে তার বাবা সবসময় উৎসাহ দিতেন।

ছোটবেলায় মা-বড় বোনদের হাতের কাজ দেখে শিখেছিলেন, আর স্কুলে কো-কারিকুলাম ক্লাসে ছিল সেলাই। সবকিছু শেখার ইচ্ছেটা প্রবল ছিল। শেখার ও জানার আনন্দটা উপভোগ করতেন। বাসায় নিজেদের শেখার জন্য বাবা সেলাই মেশিন কিনে দিয়েছিলেন তার বড় বোনকে। সবাই কমবেশি কাজ করতে পারতেন এই মেশিনে।সবুজ ও প্রকৃতিও বরাবরই মুগ্ধ করতো ফরিদা পারভীনকে। বাসায় ও বাইরে মাটির, বাঁশের, বেতের ও পাটের ব্যবহার দেখে এসেছেন। এগুলো তার খুব পছন্দের ছিল। কিন্তু, একসময় বাজারে কিনতে গেলে পাচ্ছিলেন না। দিনদিন সেগুলো হারিয়ে যেতে দেখেছেন। সেই সাথে প্লাস্টিক ও পলিথিন কিভাবে গ্রাস করছে সেটা আর এর পরিণতিও দেখেছেন ও জেনেছেন। এগুলো তাবে খুব ভাবাতো।তিনি জানতেন, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটই মুক্তি দিতে পারে। যদিও ব্যবসা হিসেবে চ্যালেঞ্জিং ছিল তার পরও উদ্যোগ হিসেবে পাটকেই বেছে নেন। চ্যালেঞ্জ নেওয়া ছোটবেলার থেকেই তার ভালো লাগে, নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতাও পছন্দ করেন। সুতরাং, নিজেই নিজেকে চ্যালেঞ্জ দিয়ে শুরু করে দিলেন।

 

তার আগে কিছু গল্প আছে।। অর্নাসের পরে ২০০৯ সালে তার বিয়ে হয়। এরপর মাস্টার্স শেষে সংসার শুরু করেন ঢাকাতে। বাবা বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় সবার আগ্রহে বিসিএস ফরম ফিলআপ করলেও অনেক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি। হাজব্যান্ডের কর্মস্থল থেকে দূরে থাকতে হবে জেনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেও যোগ দিলেন না। কিছুদিন বাসার কাছাকাছি স্কুলে শিক্ষকতা করেন।২০১৩ সালে স্মার্ট ফোন পেলেন হাতে, তবে ফেসবুক তখন তার কাছে বিনোদনের জায়গা। ততোদিনে মা হয়েছেন তিনি। মন তবু পড়ে থাকতো সুপ্ত স্বপ্নটা নিয়ে। কিন্তু বাচ্চাকে কারো কাছে রেখে যাবার মতো কেউ ছিল না। বলতে গেলে নিজেকে গুটিয়ে ফেলেছিলেন। ভেবেছিলেন তার সুযোগ হয়তো আসবে না। কিন্তু সময় তাকে মনে করে দিলো স্বাবলম্বী না হলে সংসারের হাজারটা কাজের বিনিময়ে সম্মান প্রতিষ্ঠিত হয় না। নিজেকে ভালো না বাসলে হারিয়ে যেতে হয়।ফরিদা পারভীনের বাচ্চার বয়স পাঁচ হলে তিনি পাট বিষয়ক একটা ট্রেনিং করেন ২০২০ এর জানুয়ারিতে। করোনায় সব বন্ধ হয়ে যায়। জেডিপিসিতে বা এসএমইতে ইচ্ছে থাকলেও করোনাকালীন সময়ে ট্রেনিং করা হয়নি। তখন তিনি উই গ্রুপের সন্ধান পান, নিজেকে যুক্তও করেন। রাজিব আহমেদকে পান মেন্টর হিসেবে। গুণি উদ্যোক্তাদের কাজ ও জীবনের গল্প জানতে পারেন। তখনও তিনি জানেন না তিনি কী করতে যাচ্ছেন। তবে নিয়মিত লিখতেন পাট নিয়ে। ২০১৪ সাল থেকে ইন্টারনেট সার্চ করে ন্যাচারাল পণ্য সম্পর্কে জানার চেষ্টাও ছিল তার। সুপারির খোলের প্লেট, বাটি একটা নতুন পণ্য, ইন্ডিয়াতে এর কাজ হচ্ছে। দেশের অনেকে আগ্রহ দেখাতেন, জানতেন না কী করে কী করা যায়। ধীরে ধীরে জানলেন। কিন্তু করোনায় এটা চাহিদা নেই বলে মনে হলো। তাই বাদ দিলেন।

২০২০ সালের জুন মাসেরর দিবে ভাবলেন বাচ্চাদের রেডিমেড ড্রেস ও কিছু শৌখিন পণ্য করবেন। জুনে “ইতুলবিতুল” নামে একটা পেজ খোলেন ফেইসবুকে। হাজব্যান্ড তাকে সহায়তা করেন। এটা নিয়ে কয়েক মাস চলে যায়। অল্প করে অর্ডারও পান। তার তৈরি বেবিনেস্ট ও নার্সিং পিলো মানুষ পছন্দ করতে শুরু করে।তবে, রাজিব আহমেদ-এর কথার অনুপ্রেরণায় নিজ জেলার পণ্য নিয়ে কাজ করার ইচ্ছেটা প্রবল হয় উদ্যোক্তার। লেখা ও পণ্যের ছবির কন্টেন্ট দিয়ে অনলাইনে ব্যবসা করা যায়, সেটা তিনি তার কাছে শিখেছেন।একসময় করোনা লকডাউন উঠে গেলে জুটের কাপড় ও অন্যান্য সামগ্রী এনে নিজেই বানানো শুরু করেন ছোট ছোট আইটেম। নতুন কিছু পণ্য, গতানুগতিক ধারার বাইরে।সেসময় আরেকটি পেজ খুলেন Jutofabbd নামে। তিনি সবসময় নিজের ডিজাইনে পণ্য তৈরি ও বিক্রি করার দিকে আগ্রহী ছিলেন। তাই কষ্ট যেমন বেশি হতো, খরচও বেড়ে যেতো।

২০২০ সালে অক্টোবরে করোনার মধ্যেও চলাচলের অনুমতি পেয়ে তার নিজ জেলা বরিশাল যান, মনের সুপ্ত ইচ্ছেকে সঙ্গে করে। শীতলপাটি বরিশালের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী পণ্য। পাটি হিসেবে এর ব্যবহার হলেও তিনি এটা দিয়ে ব্যাগ বানাতে চান। তিনি দেখলেন, বিশ্বের চার-পাঁচটি দেশ এটি উৎপাদন করে। সবুজ ও পরিবেশবান্ধব পণ্য হিসেবে এর কদর আছে। তাই তিনি শুরু করলেন এই উদ্যোগ।ফরিদা পারভিন জানতেন না সফল হতে পারবেন কি না। কিন্তু, মনকে স্থির করে নিলেন, এটাই হবে তার সিগনেচার পণ্য। একই সাথে চ্যালেঞ্জ পাটিকর গোষ্ঠীকে নিজ পেশায় ফিরিয়ে আনার। যেনো তার ছোটবেলার ইচ্ছেটা পূরণ হওয়ার একটা পথ দেখতে পেলেন।তিনি একই সাথে জুট ও শীতলপাটির বহুমুখি পণ্য তৈরিতে মন দিলেন। এখন ৫০টির মতো পণ্য তৈরি করেন শীতলপাটি ও জুটের। দেশে জুটের বহুমুখি পণ্যের পরিচিতি থাকলেও শীতলপাটি বহুমুখি করা নিয়ে তেমন উদ্যোগ নেই। এমনকি প্রশিক্ষণেরও সুযোগ নেই তেমন। তবে তিনি দুজন মানুষকে পেয়েছিলেন যারা জুট পণ্য বানানোর পাশাপাশি তার ডিজাইন অনুযায়ী শীতলপাটির বহুমুখি পণ্যও তৈরি করতে পেরেছিলেন। এসব পণ্য নিয়ে তিনি ২০২১-এ উই কালারফুল ফেস্ট মেলায় অংশগ্রহণ করেন। বিক্রি খুব না হলেও একটা পরিচিতি পান তিনি। মানুষ জানতে শুরু করেন এসব পণ্য নিয়ে। শীতলপাটির বোনা ব্যাগ তাকে বিশেষভাবে চিনিয়ে দেয়। টানা দেড় বছরে তিনি নিয়মিত লেখালেখি ও ছবির মাধ্যমে ক্রেতা তৈরি করতে সক্ষম হন। তারা এই দেশী পণ্যের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ও উদ্যোক্তাকে বিশ্বাস করে তাদের আলমারিতে স্থান করে দেন।

বর্তমানে বোনা ব্যাগ তৈরিতে ৪-৫ জন কর্মী কাজ করেন। এছাড়া প্রয়োজন অনুযায়ী ৪-৫ জন খণ্ডকালীন কাজ করেন তার সঙ্গে। একজন পাটিকর দিনে একটা বড় সাইজের বা দেড়টা মাঝারি বা দুইটা ছোট সাইজের ব্যাগ বুনতে পারেন, যেখানে পাটি বুনতে এক সপ্তাহ লেগে যায়।উদ্যোক্তা জানান, কাজ করতে গিয়ে কর্মীর অপ্রতুলতা, দক্ষতা ও ডেলিভারি সমস্যা নিয়ে ভুগতে হয়েছে। সময়ের সাথে ধৈর্য্য ধরে সমাধান করেছেন। নিজের কাজ নিজে করেছেন, সময়মতো কাজ শেষ করার জন্যে নিজে তত্ত্বাবধান করেছেন। প্রতিনিয়ত কিভাবে আরো একটু ভাল করা যায়, সেই চেষ্টা করে চলেছেন।

দেশের সব বিভাগে উদ্যোক্তার পণ্য যাচ্ছে। তবে ঢাকা ও চট্টগ্রামে তার পণ্যের ক্রেতা বেশি। সরাসরি এক্সপোর্ট না হলেও বন্ধু ও ক্রেতাদের হাত ধরে আমেরিকা, লন্ডন, জার্মানি ও ইতালিতে উদ্যোক্তার পণ্য গেছে।দেশের পাশাপাশি আনুষ্ঠানিক রপ্তানির চেষ্টা করছেন। কয়েকটি দেশে স্যাম্পল নিয়ে কাজ চলছে। উদ্যোক্তা সফল হলে হয়তো একশ জন, কিংবা হাজার জনেরও কর্মসংস্থান হবে। পাটিকর গোষ্ঠী হয়ত ফিরতে পারবে নিজ পেশায়। শুধু বরিশাল নয়, দেশে যে কয়টি জেলায় শীতলপাটির কাজ হয়, সবাইকে এই কাজে সংযুক্ত করতে চান উদ্যোক্তা। একে রপ্তানি পণ্যে পরিণত করাই তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings