X

শ্রীমঙ্গলের প্রকৃতি, সংস্কৃতি ও মানুষের গল্প

ভ্রমণের পরিকল্পনা ছিল বেশ কিছুদিন ধরেই। ব্যস্ত শহরজীবন থেকে কিছুদিন দূরে গিয়ে প্রকৃতির কোলে সময় কাটানোর তীব্র বাসনা থেকেই এই যাত্রার সূচনা। এই ভ্রমণে আমার সফরসঙ্গী ছিল ৮ জন প্রাণবন্ত তরুণ-তরুণী, যারা সবাই ঢাকার বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। 

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে নিঃশব্দ পথে হেঁটে চলা 
প্রথম গন্তব্য ছিল লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাকৃতিক রেইন ফরেস্ট, যেখানে রয়েছে নানা বিরল গাছপালা, বন্যপ্রাণী এবং পাখির বসবাস। প্রবেশমূল্য দিয়ে আমরা বনের ভেতরে ঢুকে পড়ি। ভ্রমণের জন্য বনে তিনটি ট্রেইল বা হাঁটা পথ রয়েছে। তিনটি পথের মধ্যে একটি ৩ ঘণ্টার পথ, একটি ১ ঘণ্টার পথ আর অপরটি ৩০ মিনিটের পথ। প্রশিক্ষিত গাইডের সহায়তায় বনের একেবারে ভেতর পর্যন্ত যাওয়া যায়। আমরা উদ্যানের ভেতরে হাঁটতে শুরু করি। চারপাশে শুধুই পাখির ডাক, গাছের পাতার শোঁ শোঁ শব্দ আর বাতাসের ছোঁয়া। প্রকৃতিকে বিরক্ত না করে চুপচাপ হাঁটলে পথে চোখে পড়বে নানা প্রজাতির কীটপতঙ্গ, গাছপালা, পাখি। ভাগ্য ভালো হলে হনুমান, বানর এবং উল্লুকেরও দেখা মিলতে পারে।

চা বাগানের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে মাধবপুর লেক
লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে বের হয়ে আমরা রওনা হই মাধবপুর লেকের পথে। পথের দুই পাশে যতদূর চোখ যায়, শুধু চা-বাগান আর সবুজের ঢেউ। আঁকাবাঁকা পথে চলতে চলতে মনে হচ্ছিল যেন সবুজের গহিনে হারিয়ে যাচ্ছি। পথে দেখা মিলল চা শ্রমিকদের কেউ দল বেঁধে বাগানের ভেতরে বসে খাওয়া-দাওয়া করছেন, কেউ আবার কাজের ক্লান্তি দূর করতে জিরিয়ে নিচ্ছেন। কোথাও আবার চোখে পড়ল সাইকেলে করে কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বহন করছেন।
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে অবশেষে আমরা পৌঁছাই মাধবপুর লেকে। কিন্তু এই জায়গার সৌন্দর্য কোনো ক্যামেরায় ধরা পড়ে না, একে সত্যিকারভাবে অনুভব করতে হয় নিজের চোখে, নিজের অনুভবে। লেকের একপাশে শাপলা ফুল ফুটে আছে। আর লেকজুড়ে স্বচ্ছ পানি যেন কোনো আয়নার মতো চারপাশের দৃশ্য ধরে রেখেছে।

মেঘাচ্ছন্ন পথে নূরজাহান টি এস্টেট
মাধবপুর লেক থেকে বের হয়েই আমরা আবার চাঁদের গাড়িতে চেপে বসি। ড্রাইভার সাহেব আগে থেকেই বলেছিলেন, ফিরতি পথে আমাদের নিয়ে যাবেন একটি সুন্দর রাস্তা ধরে। তখন ঠিক বুঝিনি- কী রকম হবে সেই রাস্তা! চা-বাগানের ভেতর দিয়ে গাড়ি যখন চলতে শুরু করল, তখনকার পরিবেশ ছিল প্রাণচঞ্চল— কেউ ছবি তুলছিল, কেউ গাইছিল গান, কেউ আবার মুগ্ধ চোখে চারপাশ দেখছিল।
একপর্যায়ে গাড়ির গতি একটু কমে এলে দেখলাম সামনের রাস্তা আসলেই সুন্দর। মাটির রাস্তা চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ; যতদূর চোখ যায় চা গাছের সারি, ছোট ছোট ঢেউয়ের মতো বিস্তৃত পাহাড়ের গায়ে। মাঝে মাঝে দেখা যায় চা শ্রমিকরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে কাজ করছেন, কেউ নিচু হয়ে পাতা তুলছেন; আবার কেউ বিশ্রামের ফাঁকে হাসিমুখে গল্প করছেন। এসব দৃশ্য যেন কোনো চলমান ছবির মতো নীরব।

কমলগঞ্জের ক্যামেলিয়া লেক
মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে অবস্থিত ক্যামেলিয়া লেক সত্যিই একটি মনকাড়া দর্শনীয় স্থান। ব্রিটিশ কোম্পানি ডানকান ব্রাদার্সের মালিকানাধীন শমসেরনগর চা-বাগানের গভীরে অবস্থিত এই লেকটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত ‘বিসলার বান’ নামে। চারপাশে চা-বাগানের সবুজ টিলা, নির্জন শান্ত পরিবেশ আর লেকের স্বচ্ছ পানিতে ঘুরে বেড়ানো অতিথি পাখি- সব মিলে এক অপূর্ব দৃশ্যপট তৈরি করে। লেকের ওপর নির্মিত পাকা পাটাতনে দাঁড়িয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন অনেকেই আনন্দ নিয়ে লেকের পানিতে সাঁতার কাটছিলেন। তবে লেকে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। ছবি তোলা, ঘুরে বেড়ানো এবং প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্য উপভোগের জন্য জায়গাটি একেবারে উপযুক্ত।

সবুজের আড়ালে নীরব কষ্ট চা শ্রমিকদের
সবুজে ঘেরা চা-বাগান যতটা সুন্দর দেখায়, তার আড়ালে লুকিয়ে আছে হাজারও চা শ্রমিকের নীরব কান্না। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তারা কাজ করেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। অথচ জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোও অনেক সময় পূরণ হয় না। অল্প মজুরি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সীমিত সুযোগ, আর মানবেতর জীবনযাপন- এসবই তাদের নিত্যদিনের বাস্তবতা। অনেকেই পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। শিশুদের স্কুলে পাঠানো যেন এক স্বপ্নের মতো। অথচ এই শ্রমিকদের ঘামে ভেজা পাতাগুলো থেকেই তৈরি হয় আমাদের প্রিয় চা। আমরা যখন সেই চা উপভোগ করি তখন কি একবারও ভাবি যারা এই পাতাগুলো তুলেছেন, তারা কেমন আছেন? চা শ্রমিকদের প্রতি সুবিচার, ন্যায্য মজুরি এবং সম্মানের জীবন নিশ্চিত করা সময়ের দাবি।

চোখে দেখা খাসিয়াপুঞ্জির মানুষের চ্যালেঞ্জিং জীবন
পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসরত খাসিয়াপুঞ্জির মানুষের জীবন যেন এক অবিরাম লড়াইয়ের নাম। মূলধারার বাইরে থাকা এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে প্রতিদিনই নানা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। সীমিত জমিতে পান উৎপাদনই তাদের প্রধান জীবিকা; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন, জমি দখল ও বন বিভাগের চাপ তাদের জীবনযাত্রাকে ক্রমশ কঠিন করে তুলছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগও খুবই সীমিত, বিশেষ করে শিশু ও নারীরা রয়েছে ঝুঁকির মুখে। অনেক সময় তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা টিকিয়ে রাখার সংগ্রামও চলে সমান্তরালে। তবুও তারা আশ্চর্য এক মানসিক শক্তি নিয়ে বেঁচে আছেন, নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রেখে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

শ্রীমঙ্গল: রেখে যাই সবুজের ছোঁয়া

এই ভ্রমণ কেবল ঘোরাঘুরির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল নিজেকে নতুন করে খুঁজে পাওয়ার এক যাত্রা। প্রকৃতির কাছে গেলে মনে হয় আমরা কত ছোট, কত অনাকাঙ্ক্ষিত কোলাহলে জড়িত থাকি সারাক্ষণ। শ্রীমঙ্গলের মানুষ, তাদের হাসিমুখ, সরলতা এবং প্রকৃতির নিঃশব্দতা আমাকে নতুনভাবে ভাবতে শিখিয়েছে। যখন ফেরার সময় এলো, মনটা ভার হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল এই সবুজ প্রকৃতি, পাহাড়, চা-বাগান ও মানুষের ভালোবাসা ছেড়ে চলে যাওয়া কি সম্ভব? কিন্তু বুঝলাম, এই ভালো লাগা মনেই গেঁথে থাকুক, যেন আবারও টানে ফিরিয়ে আনে শ্রীমঙ্গলের পথে।

কীভাবে যাবেন শ্রীমঙ্গল?
ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে চাইলে সহজতম উপায় হলো বাস বা ট্রেন। ঢাকার সায়েদাবাদ, ফকিরাপুল কিংবা কমলাপুর থেকে সরাসরি শ্রীমঙ্গলগামী বাস পাওয়া যায়। হানিফ, শ্যামলী, সিলেট এক্সপ্রেস, এনা ইত্যাদি পরিবহনের নন-এসি ও এসি বাসে চড়ে প্রায় ৫-৬ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় শ্রীমঙ্গল। যারা একটু স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করতে চান, তারা ট্রেনকে প্রাধান্য দিতে পারেন। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে পারাবত, উপবন, জয়ন্তিকা কিংবা কালনী এক্সপ্রেস ট্রেনে চড়ে সকাল বা সন্ধ্যায় রওনা দিয়ে সহজেই পৌঁছাতে পারবেন শ্রীমঙ্গল রেলস্টেশনে। শ্রীমঙ্গল পৌঁছেই রিকশা বা অটোরিকশা নিয়ে চলে যেতে পারবেন যেকোনো হোটেল, রিসোর্ট বা দর্শনীয় স্থানে।

Categories: পর্যটন
Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings