X

সংকটে বস্ত্র খাত: আট মাসে ২৬ হাজার শ্রমিক বেকার

সংকটে বস্ত্র খাত: আট মাসে ২৬ হাজার শ্রমিক বেকার

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানিমুখী খাত—বস্ত্রশিল্প—বর্তমানে চরম সংকটে পড়েছে। গত আট মাসে এ খাতে কাজ হারিয়েছেন প্রায় ২৬ হাজার শ্রমিক। গ্যাস-বিদ্যুতের উচ্চমূল্য, সুতার লাগামহীন দাম, আমদানিনির্ভরতা, নীতি সহায়তার অভাব এবং মূল্য সংযোজন কমে যাওয়া এই সংকটের মূল কারণ বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা।

বন্ধ হচ্ছে বৃহৎ কারখানা, বিনিয়োগে বিপর্যয়

দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় একটি স্পিনিং কারখানা সম্প্রতি বন্ধ হয়ে গেছে, যেখানে প্রায় ১২ হাজার কর্মী কাজ করতেন। কারখানাটির মালিক প্রতিদিন ১০ লাখ কেজি সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকার পরও জ্বালানি সংকট ও কাঁচামাল আমদানির অসুবিধার কারণে উৎপাদন বন্ধ করতে বাধ্য হন। এতে করে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ ক্ষতিতে পড়েছে বলে জানা গেছে।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশন (বিটিএমএ) জানায়, গত আট মাসে পুরো বস্ত্র খাতজুড়ে প্রায় ২৬ হাজার শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। এতে বেকারত্ব বাড়ার পাশাপাশি সমাজে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে।

সুতার বাজারে ভারত-নির্ভরতা ও নীতি বৈষম্য

বিটিএমএর তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে মোট ৪৭৮ কোটি ডলারের সুতা প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে ২৫০ কোটি ডলারের সুতা উৎপাদন করা হলেও ২২৮ কোটি ডলারের সুতা আমদানি করা হচ্ছে, যার বড় অংশই আসছে ভারত থেকে। অথচ দেশে ৩৮২ কোটি ডলারের সুতা উৎপাদনের সক্ষমতা থাকলেও সরকারের নীতিগত দুর্বলতায় সেই সক্ষমতা কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

বিটিএমএর সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, “ভারত ও চীন যেখানে শিল্পকে বিশাল প্রণোদনা দিচ্ছে, সেখানে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। মিস ডিক্লারেশন ও মাস্টার এলসির মাধ্যমে আমদানিকৃত সুতা কালোবাজারে চলে যাচ্ছে, যার ফলে স্থানীয় কারখানাগুলো আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”

প্রণোদনা কমেছে, কমেছে মূল্য সংযোজনও

এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকার পোশাক খাতে প্রণোদনা কমিয়ে দিয়েছে। এর ফলে বিশেষ করে ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা চরম ক্ষতির মুখে পড়ছেন। অনেকেই স্থানীয় বাজার থেকে সুতা না কিনে কম দামে চীন বা ভারতের বাজার থেকে আমদানি করছেন।

বিকেএমইএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, “আমার নিজের কারখানা গত আট মাসে কোনো স্থানীয় সুতা ব্যবহার করেনি। কারণ, স্থানীয় বাজারে সুতার দাম ১৭ শতাংশ বেশি। এতে আমাদের বাধ্য হয়ে বিদেশি সুতা কিনতে হচ্ছে।”

যদিও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশের পোশাক খাত এখন সাধারণ টি-শার্ট বা সোয়েটারের বাইরে গিয়ে ব্লেজার, জ্যাকেট ও লংজারির মতো উচ্চমূল্যের পণ্য রপ্তানি করছে, যার মাধ্যমে রপ্তানি আয় কিছুটা স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হচ্ছে।

মোড়ক ও সরঞ্জাম খাতেও চ্যালেঞ্জ

পোশাক শিল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে সরঞ্জাম ও মোড়ক পণ্য সরবরাহ। বিজিএপিএমইএর সভাপতি মো. শাহরিয়ার জানান, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই খাত থেকে ১৬০ কোটি ডলারের সরাসরি রপ্তানি আয় এসেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ১১ কোটি ডলার বেশি। এছাড়া প্রচ্ছন্ন রপ্তানি আয়ও রয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি ডলার।

তিনি বলেন, “বাজারে সম্ভাবনা থাকলেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুকূল নীতির অভাবে আমাদের সক্ষমতা তুলে ধরা যাচ্ছে না। দরকার শিল্পবান্ধব রাজনীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করা।”

সংকট সমাধানে কী করণীয়?

বস্ত্র খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরকার যদি এখনই সচেতন না হয়, তবে এ খাতে বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়—তিনটিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। উর্মি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, “উৎপাদন খরচ কমাতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের জটিলতা সমাধান করতে হবে। একইসাথে নীতিগত সহায়তায় ভারসাম্য আনতে হবে।”

বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ পরবর্তী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন থেকেই বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নীতিমালার মধ্যে থেকে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ও সহায়তা বাড়াতে হবে। অন্যথায় ভারত-চীনের মতো প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে শিল্প আরও এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।

 

Md Abu Bakar Siddique:
X

Headline

You can control the ways in which we improve and personalize your experience. Please choose whether you wish to allow the following:

Privacy Settings