খুলনা–বাগেরহাট আসা–যাওয়ার পথে সুযোগ পেলে ভ্যাট্টেপাড়ায় (ভাটিয়াপাড়া) বিরতি নেওয়ার চেষ্টা করি। সেখানে এক প্রবীণ চা বিμেতা খুব আদর করে চা পরিবেশন করেন। চায়ের চেয়ে মন টানে তাঁর
কথায়। কত খবর যে জমা থাকে তার ব ঁ কে!!
শুধ ু খেই ু ধরিয়ে দিলেই হলো। তিনিও জানতে চান, ‘কী ধান্দায়
কোথায় মেলা করছি। কত দিনের সফর? ফেরার পথে
রাত হবে কি না? তাড়া থাকলে একটা মিসড কল মাইরে
দেবেন। সর (দধের সর) উঠায়ে রাখব মালাই চা খাইয়ে ু
যাবেন।’ এবার ফেরার পথে দেখি, সন্ধ্যার আগেই তারঁ
দোকানের ঝাঁপ নামানো। খোজ নিতেই জানা গেল, ঁ
তাদের গ্রামের একজন বিষ খেয়েছে, তাকে নিয়ে
ছোটাছটি চলছে। দোকান বন্ধ করে ছোটাছ ু টির দলের ু নেতত্ব দিতে গেছেন প্রবীণ চা বিে ৃ μতা। আমার মিসড
কলের সত্র ধরে রাত ১১টার দিকে ফোন করলেন প্রবীণ। ূ
তিনি তখনো রোগীর সঙ্গে মেডিকেলের পথে।
ফোনে তিনি জানালেন, ‘আমরা পদ্মা সেততে। মালা ু
(ছদ্মনাম), পড়াশোনা না করে মোবাইল হাতড়াইতে
ছিল। তাই বাবায় তারে বকা দেয়। আর তাতেই রাগ
করে মালা ঘাস মারার বিষ গিলে ফেলে। মমুূর্ষু মালাকে নিয়ে এখন যমে মানুষের টানাটানি চলছে।
অব¯’া কেরোসিন (আশঙ্কাজনক)। কচি বেডিডা
বাচবে কি না কওয়া যা”েছ না।’ ঁ
মরব্বি প্রবীণ সাধারণত ম ু খ খারাপ করেন না। এবার ু করলেন, ধমকও দিলেন। তার বোধে আসে না ঁ
আমরা কী ‘ফ্যালাইতাছি’। আবার তাড়া দিলেন
‘ধান্দাবাজি’ না করে মানুষ ও মানুষের সমস্যা নিয়ে
লেখার জন্য। তিনি প্রথম আলোর একজন গুণমগ্ধু
কিš‘ ছেড়ে কথা না বলা পাঠক।
প্রবীণের ধমক খেয়ে মনে পড়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের ডা. মো.
সাদ্দাত হোসেনের কথা। একটি জাতীয় দৈনিকে গত
১০ জুন ২০২৩ প্রকাশিত এক লেখায় তিনি
বলেছিলেন,‘আগেও খেতে পোকামাকড় মারার বিষ
(ইনসেক্টিসাইড) খেয়ে মানষ আত্মহত্যা করার চেষ্টা ু করত।
বিশ্বাস করুন, যারা পোকামাকড় মারার বিষ খেয়ে
আসত, তারা যদি কোনো হাসপাতালে পৌছাতে ঁ
পারত, তবে তাদের শতকরা ৯৯ ভাগ রোগী ভালো
হয়ে যেত। কিš‘ এই ঘাস মারার বিষ খেয়ে যারাই
ভর্তি হ”েছ, এটা এতটাই বিষাক্ত যে ওদের কাউকেই
বাচানো সম্ভব হ”েছ না।’ ঁ
তিনি মানবদেহে এই বিষের প্রতিμিয়া ব্যাখ্যা করতে
গিয়ে লিখেছিলেন, ‘প্রথম দিকে এর প্রতিμিয়া তেমন
অনভু ত হয় না। শুধ ‚ জিহŸায় কিছ ু ঘা দেখা দেয়। এরপর ু
আস্তে আস্তে অন্যান্য অঙ্গ বিকল হতে থাকে। প্রথমে
কিডনি, তারপর লিভার, তারপর ফুসফুস। একপর্যায়ে
এসে শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। শেষ মহুর্তে লাইভ সাপোর্ট ূ
দেওয়া লাগে। লাইভ সাপোর্ট দেওয়ার পরও রোগীকে
বাঁচানো যায় না। কারণ, ফুসফুস আμান্ত হয়ে
ফাইব্রোসিস হয়ে যায়, যা আর কোনো চিকিৎসাই ভালো
করা যায় না।’
শুধ মান ু ষ নয় গবাদি প্রাণীও বেঘোরে মারা যা”েছ ু
ঘাস মারা বিষের যথে”ছ ব্যবহারে গবাদি প্রাণীর মতৃ ্যু
সংবাদের মর্যাদা হারিয়ে নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত
হয়েছে। গত বছরের (২০২৩) সেপ্টেম্বরে কড়িগ্রাম সদর ু
উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের যুগীর ভিটা গ্রামে ছয়টি
ছাগল ঘাস খেতে খেতে মারা যায়। কাউকে না জানিয়ে
পুকুরের পাড়ে ঘাসে কীটনাশক ছিটিয়ে দিয়েছিলেন
পকু রের মালিক রিন্ট ু মিয়া। সেই ঘাস খেয়ে ছাগলগুলো ু
মারা যায়। ঘাস খাওয়ার একপর্যায়ে ছাগলগুলো হঠাৎ
নিস্তেজ হয়ে মাটিতে পড়ে যায়। পরে ¯’ানীয় লোকজন
ছাগলগুলো বাড়িতে নিয়ে এলে চারটি ছাগল মারা যায়।
আর দটি ছাগল দ্রæত জবাই করা হয়। ু এর আগে ঝিনাইদহের শৈলক‚পার ভুলুন্দিয়া গ্রাম থেকে
বিষাক্ত ঘাস খেয়ে গরু মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটে। শুধু
ভুলুন্দিয়া গ্রাম নয়, দিন পনরোর ব্যবধানে পার্শ্ববর্তী
কয়েক গ্রাম মিলে কমপক্ষে ১২টি গরু মারা যায়।
মানষ ও গবাদি প্রাণীর অকাল ম ু তৃ ্যর চেয়ে এই ঘাস মারা ু
বিষ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্টের অন্যতম কারণ হয়ে
দাড়িয়েছে। নাম না–জানা এক তরুণ ক ঁ ষক সব দেখেশুনে ৃ
ছড়া বেঁধেছেন—
ঘাস মারা বিষ,
পাখিরা দেয় না শিস।
মারা যায় মাটির সব পতঙ্গ, কীট
বেচে থাকার অন ঁ ষঙ্গ সকল জীব। ু
সারা দেশে কৃষিজমিতে আগাছানাশকের ব্যবহার
বাড়ছে। জমি প্র¯‘ত করার আগে আগাছা দমন করা
জরুরি। ফসলের মাঠ, রাস্তার ধারের জঙ্গল, খেতের বা
পকু রের আলে গজানো ঘাসগুলোকে মেরে ফেলতে ু
চিন্তাভাবনা ছাড়াই এটি ব্যবহার করছে। ফলে জমির
উর্বরতা কমে যা”েছ।
আগে আগাছা দমন করে সেগুলো খেতের পাশে স্তপূ করে রাখা হতো। পরে চাষের সময় সেগুলো মাটির সঙ্গে
মিশিয়ে দেওয়া হতো। ফলে ফসলের জমির উর্বরতা ও
অণজীবের সংখ্যা ব ু দ্ধি পেত। বর্তমানে আগাছা দমনে ৃ
অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে সেগুলো পড়িয়ে ু দেওয়া হ”েছ। সময় ও খরচ কমার সঙ্গে সঙ্গে মাটির
ভৌত গুণাগুণ হ্রাস পা”েছ, আশঙ্কাজনক হারে কমে
যা”েছ মাটিতে অণজীবের সংখ্যা, যা মাটির স্বা¯ে’্যর জন্য ু
ক্ষতিকর।
এসব কারণে মাটির উর্বরতা কমছে দিনের পর দিন।
ফলে অনেক চেষ্টা করেও ফসলের কাঙ্ক্ষিত ফলন
মিলছে না। মাঠে গবাদিপশুর জন্য কাচা ঘাস বিষের ঁ
আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যা”েছ। নষ্ট হ”েছ গোচারণভ‚মি।
যখন বিষ দেওয়া হ”েছ, তখন পাখি, পোকামাকড় যা-ই
এই বিষের ওপর বসক না কেন বা খাবার গ্রহণ করুক ু না কেন, তারই মতৃ ্যর ঝ ু কি থাকে। নিস্তার নেই জলজ ও ুঁ
¯’লজ জীবন চμের ছোট–বড় পাখিজাতীয় প্রাণীর।
হাজারো কীটপতঙ্গ আছে, যারা উদ্ভিদ খেয়ে বেচে থাকে ঁ
আর সাপ, ব্যাঙ, শিয়াল, বনবিড়ালসহ আরও নানা রকম
প্রাণী আবার এসব ছোট কীটপতঙ্গ খেয়ে বেচে থাকে। ঁ তাই ঘাস যদি হারিয়ে যায়, তাহলে এসব প্রাণীর সংখ্যাও
দিন দিন হারিয়ে যাবে। কেঁচো, শামুকের মতো উপকারী
অনেক প্রাণীর বেচে থাকার আশ্রয় ঁ μমেই ধ্বংস হয়ে
যা”েছ। মাটিতে এই বিষ অধিক মাত্রায় ব্যবহার করার
ফলে যেসব পাখি নানা রকম ঘাসের বীজ খেয়ে ও লতা
বা গুল্মের ফল খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে, তাদেরও
খাদ্যের সংকট দেখা দিতে পারে।
আমাদের দেশীয় ও পরিযায়ী পাখি নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত
হতে পারে এই বিষμিয়ার ফলে। বন্য প্রাণীদের
খাদ্যের সংকট দেখা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের
বাস¯’ানের ক্ষেত্রেও সংকট দেখা দেবে। কারণ,
এসব প্রাণী ছোট ঝোপঝাড়ে লকিয়ে থাকে বা ু ঝোপের নিচে গর্ত করে বসবাস করে। কিš‘ বিষ
প্রয়োগের ফলে ঝোপের সংখ্যা μমেই কমে যা”েছ,
যার ফলে বন্য প্রাণীও পড়ছে বাস¯’ানের সংকটে।
দেশের অনেক মানুষ এখনো প্রকৃতিতে কুড়িয়ে
পাওয়া শাক, নানা রকম সবজি শস্যদানা সংগ্রহ
করে খাদ্য ও পষ্টির চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। ু
অনেকে, বিশেষ করে প্রান্তিক নারীরা এগুলো সংগ্রহ
করে হাটবাজারে বিμি করেন। জীবিকার এটাও
একটা পথ। কিš‘ এই বিষ ব্যবহারের ফলে সেসব
পথ μমেই রুদ্ধ হয়ে যা”েছ। প্রাকতিক এসব ৃ
খাদ্যভান্ডার থেকে বঞ্চিত হ”েছন হাজারো মানুষ।
এতে দেখা দেবে পষ্টির ঘাটতিও। ু প্রকৃতিতে কড়িয়ে পাওয়া খাদ্য শুধ ু ু মানুষের খাবার
হিসেবে নয়, বরং এর নানান ঔষধিগুণের কারণে
গ্রহণ করে থাকেন। কিš‘ রাস্তার ধারেই হোক বা
পুকুরের পাড়েই—সব জায়গায় এখন বিষ ছিটানো
হ”েছ। ফলে ‘দষ্প্রাপ্য’ হয়ে পড়ছে এসব নিখরচার ু
অমল্য খাদ্যসামগ্রী। ূ তারপরও এই বিষ কেন এত জনপ্রিয়
ফসলের জন্য জমি তৈরির আগে আগাছা দমন করা
জরুরি। জমিতে ধান কাটার পরে প্রচুর পরিমাণে
আগাছা জন্মায়। হাল আমলে শ্রমিকের মজরি ব ু ৃদ্ধি
ও শ্রমিকের অভাবের কারণে কষকেরা আগাছানাশক ৃ ব্যবহারে ঝকছে। এক বিঘা জমির আগাছা দমন করতে ুঁ
হলে এলাকাভেদে ১৫ থেকে ২০ জন শ্রমিক লাগে।
সেখানে ১৮০ টাকার বিষ দিলেই আগাছা পড়ে যা”েছ। ু
সকালে বিষ দিলে বিকেলেই মরে যা”েছ আগাছা। ফলে
কম খরচে আগাছা দমনের সযোগ কেউ হাতছাড়া করতে ু
রাজি নন।
কষক জানেন, আগাছা হাতে ত ৃ ুলে মাটিতে পতে দিলে ুঁ
মাটির উর্বরতা বাড়ে, তবে তাতে খরচ বেশি। যেভাবেই
হোক খরচ তাকে কমাতে হবে। সবকিছর খরচ বাড়ার ু
সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে জমির মালিকের আগাম
বায়নার হার। আগে যে জমি এক সনের জন্য পাচঁ হাজার টাকা আগাম দিতে হতো, এখন সেখানে দিতে
হয় ১৫ হাজার টাকা। উর্বরতার জন্য জমির ‘কান্না’ তাই
এখন আর কষককে নাড়া দেয় না। ক ৃ ষক জানেন, ৃ
ধানখেতে আগে যে রকম মাছ পাওয়া যেত, এখন আর
পাওয়া যায় না। কমে গেছে ব্যাঙ প্রজাতি, হারা”েছ
জলজ প্রাণীও