সড়কের দুই পাশে সারি সারি কাঁঠালের স্তূপ। সকাল থেকে আশপাশের পাহাড়, টিলা আর গ্রাম থেকে কাঁঠাল এসে জমা হচ্ছে ব্রাহ্মণবাজারে। কেউ দাঁড়িয়ে আছেন বিক্রির আশায়, কেউবা আসছেন কাঁঠাল নামিয়ে নতুন স্তূপ সাজাতে। হাটজুড়ে বইছে পাকা কাঁঠালের ঘ্রাণ। এই ঘ্রাণ ভেদ করে ছুটে আসছেন পাইকার ও খুচরা ক্রেতারা।
এমন চিত্র দেখা গেল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ব্রাহ্মণবাজার এলাকায় সড়কের পাশে অবস্থিত শতবর্ষী কাঁঠালের হাটে। সপ্তাহজুড়ে বাজার চললেও সোম ও বৃহস্পতিবার এখানে জমে ওঠে সাপ্তাহিক হাট।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, এ বছর মৌলভীবাজার জেলায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে জেলার সুস্বাদু কাঁঠাল যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্তে।
গতকাল সোমবার সকালে হাটে গিয়ে দেখা যায়, কেউ বাইসাইকেলে, কেউ ঠেলাগাড়িতে আবার কেউ সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে কাঁঠাল নিয়ে আসছেন। হাটজুড়ে ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাক আর দরদামের কোলাহলে মুখর পরিবেশ। প্রতিটি স্তূপে ৫০ থেকে ৩০০ কাঁঠাল পর্যন্ত রাখা হচ্ছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কেনাবেচা।
হাটজুড়ে শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল। টিলাগাঁও, হিংগাজিয়া, পৃথিমপাশা, কর্মধা, বুধপাশা, হাজীপুর, লংলা, রাজনগরের তারাপাশা, টেংরা- এসব টিলা ও চা-বাগান ঘেরা এলাকা থেকে প্রতিদিন ভোরে কাঁধে, ঠেলাগাড়িতে কিংবা সাইকেলে কাঁঠাল নিয়ে হাজির হন চাষিরা।
স্থানীয় পাইকাররা চাষিদের কাছ থেকে এসব কাঁঠাল কিনে রাস্তার ধারে স্তূপ করেন। এরপর বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ, তাজপুর, ফেঞ্চুগঞ্জ, নবীগঞ্জ, শেরপুর, গোয়ালাবাজার, বিশ্বনাথসহ নানা স্থান থেকে আসা বড় পাইকারদের কাছে বিক্রি করা হয়। দুই-তিন হাত ঘুরে এসব কাঁঠাল পৌঁছে যায় দেশের বিভিন্ন হাটে, দেড়-দুই গুণ বেশি দামে।
কর্মধা ইউনিয়নের শফি মিয়া প্রায় ২০ বছর ধরে এই হাটে ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ির গাছের বড় আকারের ৬০টি কাঁঠাল এনেছি। সব কাঁঠালের দাম ৩ থেকে ৪ হাজার টাকার মধ্যে উঠানামা করছে।’
লংলা এলাকার ফয়সাল মিয়া জানান, ‘বাড়ির ছয়টি গাছ থেকে ৮টি কাঁঠাল এনেছি। দাম চাইছি ৮০০ টাকা, ৫০০ টাকা পর্যন্ত হচ্ছে।’
নবীগঞ্জ থেকে আসা ব্যবসায়ী সুমন পাল হাটে কিনেছেন ২৫০টি কাঁঠাল, ১৭ হাজার ৫০০ টাকায়। তিনি জানান, ‘প্রতি হাটবারেই কাঁঠাল কিনতে এখানে আসি।’ জেলা সদরের কয়ছর মিয়াও এসেছেন এই হাটে। তিনি বলেন, ‘৫০টা কাঁঠাল কিনেছি। বিক্রি করে ৫০০-৭০০ টাকা লাভ হবে আশা করি।’
অপর ব্যবসায়ী আবদুল মান্নান জানান, ‘দাম মোটামুটি ভালো, তবে বিক্রি ভাগ্যের ওপর। ২০০টি কাঁঠাল কিনেছি ১৪ হাজার টাকায়, এখন ক্রেতার অপেক্ষায় আছি।’
হিংগাজিয়া গ্রামের সমীরণ দাস বলেন, ‘হাটে আসা স্থানীয় কয়েকজন চাষির কাছ থেকে ছোট-বড় মিলিয়ে ১০০ কাঁঠাল ৮ হাজার টাকায় কিনেছি। দরদাম মিলে গেলে বিক্রি করব।’
এই হাটে সমীরণ দাসের মতো অর্ধশতাধিক পাইকার রয়েছেন, যারা স্থানীয়ভাবে কাঁঠাল কিনে দূর-দূরান্তের পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন। স্থানীয় বাসিন্দা সাহেদ আহমদ বলেন, ‘প্রতিবছর কাঁঠালের মৌসুমে নিজের বাড়ির কাঁঠালসহ আশপাশের বিভিন্ন বাগান ও বাড়ি থেকে কাঁঠাল কিনে এই হাটে বিক্রি করি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক জালাল উদ্দিন বলেন, ‘মৌলভীবাজারের টিলার মাটি কাঁঠাল চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ বছর জেলায় ২ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে প্রায় ৫ লাখ টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়েছে।’
বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় কাঁঠাল ঘিরে প্রাণচাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে ব্রাহ্মণবাজার হাটে। কাঁঠাল বেচাকেনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজারও মানুষের জীবিকা। এই শতবর্ষী হাট তাই শুধু বাজার নয়, হয়ে উঠেছে একটি উৎসবমুখর মিলনমেলা।