পর্যটন
মহাস্থানগড় ভ্রমণ অতীতকে ছুঁয়ে দেখার এক অনন্য অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য যদি আমাদের আত্মপরিচয়ের মূল ভিত্তি হয়, তবে মহাস্থানগড় নিঃসন্দেহে সেই ভিত্তির অন্যতম প্রাচীন ও গৌরবময় স্তম্ভ। এটি শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, বরং আমাদের অতীতের জানালা, যা দিয়ে উঁকি দিলে দেখা যায় ২ হাজার বছরেরও বেশি পুরোনো সভ্যতা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির চিত্রপট। তাই মহাস্থানগড় ভ্রমণ শুধু একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নয়, এটি ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ। বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত মহাস্থানগড় এক সময় প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরীর রাজধানী ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দী থেকে শুরু করে পাল ও সেন শাসনামলের শেষ পর্যন্ত এই শহর ছিল রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু। এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, যেমন গোকুল মেধ, শীলাদেবীর ঘাট, দুর্গ প্রাচীর এবং পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ চিত্র- সবই এক সমৃদ্ধ অতীতের প্রমাণ বহন করে। মহাস্থানগড়ে ভ্রমণ ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, ধর্মতত্ত্ব ও সংস্কৃতির শিক্ষার্থীদের জন্য একটি জীবন্ত শ্রেণিকক্ষ। প্রাচীন স্থাপত্য, প্রাচীন মুদ্রা, মূর্তি ও অন্যান্য নিদর্শন পরিদর্শনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বইয়ের পাতার বাইরের জ্ঞান অর্জন করতে পারে। গবেষকদের জন্য এখানে রয়েছে অজস্র অনুসন্ধানযোগ্য তথ্য ও নিদর্শন যা এখনো অনেক রহস্য উন্মোচনের অপেক্ষায়। যে জাতি তার অতীতকে জানে না, সে ভবিষ্যতের পথ হারিয়ে ফেলে। মহাস্থানগড় সেই পরিচয়চিহ্ন, যা আমাদের পূর্বসূরিদের জ্ঞান, দক্ষতা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জাগিয়ে তোলে। এটি আমাদের শিকড়ের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে এবং তরুণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে তাদের সংস্কৃতি ও ইতিহাস জানার আগ্রহ সৃষ্টি করতে। মহাস্থানগড় হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলিম- তিন ধর্মেরই নিদর্শন বহন করে। এটি একটি অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের প্রতীক, যেখানে ধর্মীয় সহাবস্থান ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বাগত জানানো হয়েছে যুগ যুগ ধরে। এই দৃষ্টিভঙ্গি বর্তমান সমাজে সহনশীলতা ও সংহতির জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। মহাস্থানগড় ভ্রমণ মানে শুধুই একটি ভ্রমণ নয়, এটি আত্মজাগরণের একটি রূপ। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, আমরা একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। তাই মহাস্থানগড়কে শুধু ভ্রমণকেন্দ্র নয়, বরং একটি জাতীয় শিক্ষাকেন্দ্র, গবেষণাগার ও পরিচয়ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা উচিত। আজকের এই দ্রুতগতির পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আমরা যখন নিজেদের হারিয়ে ফেলি, তখন মহাস্থানগড়ের মতো স্থান আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- আমাদের শিকড় কতটা গভীরে, আর ইতিহাস কতটা গৌরবময়। যেভাবে যাবেন ঢাকা থেকে গাবতলী বা কল্যাণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি বগুড়া যাওয়া যায়। বিআরটিসি, এসআর ট্রাভেলস, শ্যামলী, হানিফ এবং ঐশী এক্সপ্রেসসহ বেশ কয়েকটি পরিবহন কোম্পানির বাস চলে। ভাড়া সাধারণত ৫৫০-৯০০ টাকা (নন-এসি/এসি)। সময় লাগে সাধারণত ৫-৬ ঘণ্টা। তবে রাস্তার অবস্থা অনুযায়ী পরিবর্তন হতে পারে। বগুড়া শহর থেকে মহাস্থানগড়ের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার। অটোরিকশা, সিএনজি বা লোকাল বাসে সহজেই পৌঁছানো যায়। সময় লাগে ২০-৩০ মিনিট। ভাড়া প্রায় ৫০-১০০ টাকা (যানবাহনের ধরন অনুযায়ী)। ট্রেনে ঢাকা থেকে মহাস্থানগড় যেতে চাইলে ঢাকা থেকে সান্তাহার পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তনগর ট্রেন রয়েছে। যেমন- লালমনি এক্সপ্রেস, রংপুর এক্সপ্রেস। সান্তাহার থেকে বগুড়া বাসে বা লোকাল ট্রেনে যাওয়া যায়। সময় লাগে ৬-৮ ঘণ্টা। ভাড়া ২০০-৮০০ টাকা (শ্রেণিভেদে)। বগুড়ায় বিমানবন্দর নেই। তবে আপনি চাইলে ঢাকা থেকে সৈয়দপুর/রাজশাহী হয়ে ফ্লাইটে যেতে পারবেন। সেখান থেকে বগুড়া সড়কপথে (৩-৪ ঘণ্টা) যেতে হয়। মহাস্থানগড় ভ্রমণে সতর্কতা মহাস্থানগড় বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গৌরবের এক অমূল্য নিদর্শন। এই প্রাচীন স্থানের সৌন্দর্য ও ইতিহাস উপভোগ করতে গেলে কিছু সতর্কতা মেনে চলা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হওয়ায় এর সংরক্ষণ প্রয়োজন এবং ভ্রমণকারীদের নিরাপত্তাও নিশ্চিত করতে হয়। মহাস্থানগড়ে খাবার পানীয়ের সুবিধা সীমিত, বিশেষ করে প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকায়। তাই ভ্রমণে পানি ও হালকা খাবার সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ভালো। বিশেষ করে গরমকালে ডিহাইড্রেশন এড়াতে পানি অবশ্যই প্রয়োজন। এখানের মাটির পথ ও ধূলিকণা অনেক সময় হাঁটার জন্য অস্বস্তিকর হতে পারে। তাই চমৎকারভাবে হাঁটার জন্য হালকা, আরামদায়ক কাপড় এবং মজবুত, বন্ধ জুতা পরিধান করুন। মহাস্থানগড় বিশাল একটি এলাকায় ছড়িয়ে আছে। একটি অভিজ্ঞ স্থানীয় গাইড ভ্রমণকে সহজ, তথ্যবহুল এবং নিরাপদ করে তোলে। গাইড আপনাকে ইতিহাস সম্পর্কে বিস্তারিত জানাতে পারবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা থেকে দূরে রাখবে। পুরোনো স্থাপনা ও নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের অধীনে রয়েছে। সেগুলোতে হাত দেওয়া, ছোঁয়া বা ভাঙচুর করা নিষেধ। ভ্রমণকালে এই বিষয়টি অবশ্যই মেনে চলুন। বড় জায়গায় ভিড় কম থাকার কারণে সুরক্ষার দিক থেকে সতর্ক থাকা জরুরি। মূল্যবান জিনিসপত্র নিরাপদ স্থানে রাখুন এবং একা দূরবর্তী এলাকায় যাওয়া এড়িয়ে চলুন। মহাস্থানগড়ে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান ঘোরার জন্য ভালো করে সময় দিতে হবে। তাড়াহুড়ো করবেন না, কারণ বেশ কিছু অংশ হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সকালবেলা বা বিকেলের আগে যাওয়া ভালো, কারণ দুপুরে গরম বেশি থাকে। বৃষ্টি বা বন্যার সময় সেখানে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। আগে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দেখে যাওয়া উচিত। মহাস্থানগড়ের মতো ঐতিহাসিক স্থানকে পরিচ্ছন্ন রাখা আমাদের দায়িত্ব। কোনো ধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা থেকে বিরত থাকুন এবং সঠিক স্থানে আবর্জনা ফেলুন। ভ্রমণ পরামর্শ মহাস্থানগড় ভ্রমণের জন্য শীতকাল (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) সবচেয়ে উপযোগী সময়। বগুড়া শহরে ভালো মানের হোটেল ও গেস্ট হাউস রয়েছে থাকার জন্য। জাদুঘর ও প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রবেশ টিকিট নিতে হয় (বাংলাদেশি ও বিদেশি দর্শনার্থীর জন্য আলাদা হার)।…